সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা কি ফুরিয়ে যাচ্ছে?

একসময় সিনেমা হল ছিল বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম। বিশেষ কোনো উপলক্ষ্যে বা বিশেষ ছবি মুক্তি পেলে মানুষ দলবেঁধে সিনেমা হলে যেত। টিকিট পেতেও অনেক কাঠখড় পোহাতে হতো। বিশেষ কোনো দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠলে করতালিতে ভরে যেত পুরো হল।

‘বেদের মেয়ে জোছনা’র মতো জনপ্রিয় ছবি তো মাসের পর মাস ধরে হলে চলেছে। সেই সিনেমা হল এখন হুমকির মুখে। গত দুই দশকে অনেক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে চলমান অতিমারির প্রভাব পড়েছে বিনোদন অঙ্গনেও। কয়েক দফায় বন্ধ থেকে সম্প্রতি খুলেছে সিনেমা হল। প্রদর্শিত হচ্ছে দেশের সিনেমা। দর্শক আস্তে আস্তে ফিরছে পুরনো অভ্যাসে। যদিও ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সিনেমা হল। 

আশার কথা হচ্ছে যে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হচ্ছে সিনেপ্লেক্স। এরই মাঝে জেগেছে শঙ্কাও। করোনাকালে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে দর্শক। বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশি-বিদেশি একাধিক অ্যাপ। সিনেমা সংশ্লিষ্টদের মনে প্রশ্নে জাগছে, তবে কি ফুরিয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা? 

৯০-এর দশকের শুরুতে সারাদেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। ব্যবসায়ও ছিল রমরমা। তবে এখন বাংলাদেশের সিনেমা হলে দুর্দিন চলছে। বর্তমানে কিছু জেলায় হাতে গোনা কয়েকটি সিনেমা হল টিকে আছে। মুষ্টিমেয় যে কয়টি টিকে রয়েছে, তা-ও ধুকে ধুকে চলছে। বেশিরভাগ সিনেমা হল ভেঙে ফেলে সেখানে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, ভবন, মসজিদ-মাদ্রাসা বা গোডাউন করা হয়েছে। আর যে কয়টি এখনো টিকে রয়েছে, সেখানে দর্শক তেমন যায় না। সিনেমা হলের পরিবর্তে প্রযোজকরা এখন ছোট পর্দায় এবং নেটিফ্লিক্সে ছবি মুক্তি দেওয়ার ব্যপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। 

দর্শক, সিনেমা হল মালিক ও সিনেমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় সব সিনেমার একই কাহিনী, প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকা, আকাশ সংস্কৃতির দাপট, ইন্টারনেটে সিনেমার সহজপ্রাপ্ততা, বিদেশি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার কারণে সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দর্শকরা। তারা বলছেন, প্রণোদনা মিললে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের সিনেমা হল।

এ বিষয়ে আলাপকালে চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, সিনেমা হলের প্রয়োজন কখনো ফুরিয়ে যাবে না। কাঠামোর পরিবর্তন হবে। আগে যেমন ১০০০ সিটের সিনেমা হল ছিল, তার জায়গা নিবে আধুনিক সিনেপ্লেক্স। মাল্টিপ্লেক্স প্রযুক্তির ব্যবহার করে পুরনো হল আধুনিক হবে। কারণ মানুষের আয় বেড়েছে। একটু বেশি টাকা খরচ করে আধুনিক সিনেমা হলে আরামে সিনেমা দেখতে চায় দর্শক। সরকার যে বিশেষ তহবিল দিয়েছে আমার ধারণা- যারা আধুনিক সিনেমা হল নির্মাণ করতে চায়, তারা এটা পাবে। 

তিনি আরও বলেন, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কখনো সিনেমা হলের বিকল্প হতে পারে না। নেটফ্লিক্স আমেরিকার, অথচ সেখানে সিনেমা হল টিকে আছে বহাল তবিয়তে। আমাদের দেশেও সময়ের অভাবে কিছু দর্শক ওটিটিতে সিনেমা দেখছেন; কিন্তু বিনোদনের মূল জায়গা সিনেমা হল। তার আবেদন ও প্রয়োজন সবসময় অটুট থাকবে।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, আমাদের সিনেমা হলে ভালো মানের সিনেমা প্রদর্শিত হয় না। একটা একটা করে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে বাঁচাতে প্রচুর ভালো মানের সিনেমা দরকার। বাইরের সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে হলগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। আমাদের মধুমিতা সিনেমা হলের আধুনিকায়ন চলছে। ইতিমধ্যে সাউন্ড সিস্টেম এনেছি। সামনে আরও সংস্কার হবে। তখন ভালো মানের দেশি-বিদেশি সিনেমা প্রদর্শন করলে দর্শক হলে ফিরবেন বলে আশা করা যায়। 

তিনি ওয়েব প্ল্যাটফর্মকে সিনেমা হলের বিকল্প ভাবেন না। তার ভাষ্য, আমি কখনোই মনে করি না ওটিটি বা ওয়েব প্ল্যাটফর্ম বড় পর্দার জন্য হুমকি। সত্তর দশকের শেষে কিংবা আশির দশকের শুরুতে যখন ভিসিপি, ভিসিআর শুরু হয়, তখনো মনে হয়েছিল সিনেমা হল থাকবে না। কিন্তু হয়নি; এখনো হবে না। সাময়িকভাবে মনে হচ্ছে, সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। আদতে সিনেমা হল টিকে থাকবে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা ইফতেখার চৌধুরীর হাত ধরে ঢাকার চলচ্চিত্র আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়। ২০১০ সালে তার পরিচালনায় নির্মিত ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ ছিল দেশের প্রথম ডিজিটাল সিনেমা। দর্শকপ্রিয় এ নির্মাতা মনে করেন সিনেমা হল বেঁচে থাকবে সবসময়। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, সিনেমা হলের কখনো বিলুপ্তি ঘটবে না। অতিমারির জন্য মনে হচ্ছে, প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। যখন নিয়মিত শো হবে, তখন ঠিকই দর্শক হবে। আসলে দর্শক বিনোদন চায়। তাদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম আছে, যেমন- টেলিভিশন, ইউটিউব, ওটিটি ইত্যাদি। বাসায় বসে ৮০ ইঞ্চি টেলিভিশনে সিনেমা দেখলেও হলের মজা পাওয়া যাবে না। কারণ সিনেমা হলে বন্ধু কিংবা পরিবারের লোকজন নিয়ে গেলেও অন্যরকম একটি আবেদন থাকে। তা ঘরে বসে পাওয়া যাবে না। 

বিশিষ্ট অভিনেতা ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর চুটিয়ে কাজ করছেন সিনেমায়। সম্প্রতি শাহীন সুমনের ওয়েব সিরিজ ‘মাফিয়া’র শুটিং করেছেন এ গুণী অভিনেতা। তিনি মনে করেন, সিনেমা হলের চাহিদা কখনো কমবে না। একসময় আমরা মাসে বা সপ্তাহে একটা করে সিনেমা দেখতাম টেলিভিশনে। এখন টিভি খুললে প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই আমার সিনেমা চলতে দেখি। দর্শক ইউটিউবে সিনেমা দেখছে। মোবাইলের ছোট পর্দায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে টাকা দিয়ে সিনেমা দেখছে তারা। আবার একটা শ্রেণি হলে গিয়েও সিনেমা দেখছেন। 

অতীতের তুলনা টেনে এ দর্শকপ্রিয় অভিনেতা বলেন, আগে সিঙ্গেল স্ক্রিনে সিনেমা দেখার সময় চিপস ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যেত না। তবু ঘাম ঝরিয়ে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে সিনেমা দেখেছি। এখন মানুষ ভালো খাবার খেতে খেতে সিনেমা দেখছেন। প্রযুক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি এসেছে; কিন্তু সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা কখনো কমেনি। ভবিষ্যতেও কমবে না। 

নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব স্বৈরাচারবিরোধী স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বড় পর্দার জন্য নির্মাণ করেছেন ‘রাত্রির যাত্রী’। অভিনেত্রী মৌসুমী অভিনীত ছবিটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় ভারতে প্রদর্শিত হচ্ছে। পরবর্তী সিনেমার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন হাবিব। তিনি মনে করেন, সিনেমা প্রদর্শনের ধরন বদলালেও, সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আনন্দ ও আবেদন যুগ যুগ ধরে থাকবে। নতুন মাধ্যম আসবে; কিন্তু সিনেমা হল থাকবে। রেডিও পুরনো প্রযুক্তি হলেও, এখনো মানুষ কিন্তু শুনছে। ল্যান্ডফোন টিকে আছে স্মার্টফোনের পাশাপাশি। মানুষ একসময় ক্লান্ত হয়ে পুরনোর দিকে ছুটে যায়। 

তিনি আরও বলেন, সিঙ্গেল স্ক্রিন থাকবে না। তার জায়গা নেবে সিনেপ্লেক্স বা মাল্টিপ্লেক্স। মানুষ শপিং করতে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায়। বাইরে খেতে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায়। এ ধরনের ব্যবস্থা যেখানে থাকবে, সেখানে মানুষ যাবে। বড় পর্দায় দেখা ছবির আবেদন থাকবে; কিন্তুহল টিকিয়ে রাখার জন্য সিনেমার মতো সিনেমা অবশ্যই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে, জীবন ঘনিষ্ঠ হতে হবে। মানুষের মন মেজাজ বুঝে রুচিশীল সিনেমা করতে হবে। 

চলচ্চিত্র অঙ্গনের সুদিন ফেরাতে আধুনিক সিনেমা হলের বিকল্প নেই। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে পুরনো সিনেমা হল পরিণত হতে পারে আধুনিকতার ছোয়ায়। প্রযুক্তিকে গ্রহণ করছে মানুষ। ওয়েব প্ল্যাটফর্মে ঝুঁকছে দর্শক। তাই বলে কমছে না বড় পর্দার আবেদন। মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মাণ করা হলে দেশের সিনেমা হলগুলো টিকে থাকবে। হলে দেশের সিনেমা দেখতে যাবে দর্শক আর হাসি ফিরে আসবে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের মুখে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //