হানিফ সংকেত ও ইত্যাদি

‘এই মিলনায়তন ও এই মিলনায়তনের বাইরে যে যেখানে বসে এই অনুষ্ঠান দেখছেন আপনাদের সবাইকে জানাই সাদর সম্ভাষণ’- চিরচেনা এই শব্দমালা নিয়ে টিভি পর্দায় দুইযুগেরও বেশি সময় ধরে দর্শকদের সম্ভাষণ জানিয়ে আসছেন হানিফ সংকেত। 

বহুল জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের আপামর জনগণের কাছে পৌঁছে গেছেন। আমরা কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হয়ে  গেলেও ‘ইত্যাদি’ আছে আগের মতোই, আছেন হানিফ সংকেত। 

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের টিভিতে কত ধরনের অনুষ্ঠান এলো-গেল, ‘ইত্যাদি’ ঠিকই রয়ে গেল। হানিফ সংকেতের ছন্দময় সব সংলাপ, আইডিয়া, গানের কথা, ভয়েস ওভার। দর্শক যতক্ষণ ইত্যাদি দেখে, ততক্ষণ তারা হানিফ সংকেতকেই দেখেন। এ কারণেই ইত্যাদি আর হানিফ সংকেত একে অন্যের পরিপূরক। 

জন্ম বরিশালে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে। মূলনাম এ. কে.এম. হানিফ। হানিফ সংকেত নামটাই একটা প্রতিষ্ঠান। এক জীবনে যা করেছেন ও করে যাচ্ছেন তার কোনো তুলনা হয় না। লিজেন্ড ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা যায় তাকে। ফজলে লোহানীই তার উপস্থাপনার গুরু। পরবর্তী সফল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও সফল উপস্থাপক হিসাবে ইত্যাদিতে আগমন ঘটে হানিফ সংকেতের। 


তার উপস্থাপনা অনবদ্য। ইত্যাদি শুধু বিনোদনে নয় মানবিক বিষয় উপস্থাপন, সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরা, মানুষের কল্যাণে অবদান রাখা, প্রতিভা অন্বেষণ ও প্রতিষ্ঠিত করা এসবের জন্য একটি আদর্শ অনুষ্ঠান। নব্বই দশকের প্রজন্মের কাছে এ অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তার কোন উচ্চতায় ছিল সেটি নতুন করে বলবার দরকার নেই।

ইত্যাদির বিদেশি ছবির বাংলা ডাবিং যে তিনিই করতেন হয়তো অনেকে জানেও না। সেগুলো শুনতে শুনতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। বাংলা ফানি ডাবিংগুলো তার নিজেরই করা। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক কৌতুক, স্যাটায়ার ( যেমন কাশেম টিভি রিপোর্ট),  মেসেজ তো আছেই। নানা-নাতির জনপ্রিয় পর্ব কিংবা নানি-নাতির পর্ব দিয়ে আলাদা  ক্রেজও তৈরি করেছেন ইত্যাদিতে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে দর্শকদের পরিচিতি দিতেন। 

তার মতো স্টাইল করে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে নকল করতে গিয়ে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছিল অন্যান্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে। তিনি একমাত্র উপস্থাপক যিনি  কোনো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে দর্শকদের গাছ উপহার দিয়েছেন। তার ভাষায় গাছ হলো ‘পরিবেশবন্ধু।’ তিনিই একমাত্র উপস্থাপক যিনি ইত্যাদির পাশাপাশি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানে দর্শক চাহিদায়  সেরা উপস্থাপক।

উপস্থাপনা যে একটি শিল্প তিনি প্রমাণ করেছেন। দেশে প্রথম ভেজালবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে শুরু হয়, এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাহসী কোনো অনুষ্ঠান ( যেমন ক্রাইম  প্রোগ্রাম) এগুলোর আইডিয়া বা অনুপ্রেরণা ইত্যাদি। বিবিসির জরিপেও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছে ইত্যাদি।

টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের প্রযোজনাশিল্পে তিনি অন্যতম সেরা পথ প্রদর্শক। তার প্রযোজনায় অন্যান্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যেমন ‘ঝলক, ঈদ আনন্দমেলা, কথার কথা’ এগুলো প্রচার হতো।

১৯৮৯ সালের মার্চে প্রচারিত হয় ইত্যাদির প্রথম পর্ব। শুরুর দিকে প্রচারিত হতো মাসে দুইবার। বিটিভির প্যাকেজ যুগের প্রথম প্যাকেজ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানও ইত্যাদি। তারপর থেকে কত কিছুর বদল হলো। বিটিভি দর্শক হারাল, স্যাটেলাইট যুগ এলো, এলো ইউটিউব-ওটিটির যুগ। মুঠোফোনের কল্যাণে হাতের মুঠোয় বিনোদন দুনিয়া নিয়ে বসে আছে দর্শক, তবু ইত্যাদির আবেদন এতটুকু কমেনি তাদের কাছে। 

ইত্যাদির অর্জনের তালিকা অল্প কথায় লিখে শেষ হবে না। নিবেদিতপ্রাণ মানুষের সন্ধানে সারা দেশে ছুটে বেড়ান হানিফ সংকেত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রচারবিমুখ আলোকিত মানুষকে তিনি তুলে এনেছেন বরাবরই, যাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান।

বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন, পানির অপচয় রোধ, গ্যাসের অপব্যবহার রোধ, বৃক্ষরোপণ, শিক্ষা, পরিবেশদূষণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, শিশুশ্রম, শিশুদের  খেলার মাঠ, প্রতিবন্ধীদের ওপর প্রতিবেদন, অসুস্থ শিল্পী ও মানুষকে নিয়ে মানবিক প্রতিবেদন থাকে প্রায় প্রতি পর্বেই। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল নিরোধকল্পে প্রথম  মোবাইল কোর্ট চালু হয়েছিল ইত্যাদির উদ্যোগেই। 

গণপরিবহনের পেছনে লেখা কুরুচিপূর্ণ অশোভন স্লোগান হটিয়ে শিক্ষামূলক স্লোগান লেখার রীতি শুরু হয়েছে ইত্যাদির মাধ্যমে। নগর ছাদ বাগানের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি করেছে ইত্যাদি। এমন উদাহরণ আছে শতাধিক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //