মুহম্মদ খসরু

চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ

মুহম্মদ খসরু, প্রাণপ্রিয় খসরু ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পুনর্মিলন হয়েছিল উত্তর প্রজন্মের চলচ্চিত্র প্রেমিক বন্ধুদের মাধ্যমে! এখানে ‘পুনর্মিলন’ শব্দটিকে ঘিরে পাঠকের আগ্রহ নিরূপণের জন্য খানিকটা বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। আমরা যারা ৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমত ফিল্ম সোসাইটি ও পরবর্তীকালে বিকল্প চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্ম-বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সঙ্গে যুক্ত হই, তখন দেখেছিলাম খসরু ভাইয়ের নাম নেওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠনের সবাই বিশেষ সাবধানতা ও খানিকটা রাখঢাক অবলম্বন করেন। শাহবাগ বা তৎসংলগ্ন এলাকায়, পাবলিক লাইব্রেরি বা জাদুঘর বা রাতের কোনো বারে কদাচিৎ দেখা হয়ে গেলেও আমাদের অগ্রজদের ও খসরু ভাইয়ের মাঝে এক চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে দেখতাম। ওদিকে যে অগ্রজের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যেত, তিনি এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করতে চাইলেই-খসরু ভাই প্রথমত, তাকে নিরস্ত করতেন কুৎসিত গালি বর্ষণ করে, নয়তোবা কোনো প্রতি-উত্তর না দিয়েই উল্টোমুখে ফিরে- তাঁর সেই ব্যাগ কাঁধে বিখ্যাত কুঁজো ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে সদলবলে (সঙ্গীসাথী সহযোগে) সেই এলাকা ত্যাগ করতেন। এটি মোটামুটি নৈমিত্তিক বিষয় ছিল এবং লোকটির এহেন আচরণে, অগ্রজরা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় হলেও আমরা লোকটির নিষ্ঠুরতার প্রতিক্রিয়ায় তাঁর প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে উঠতাম তৎক্ষণাৎ। 

আমাদের মাঝেই গুটিকতক বন্ধু ও শর্ট ফিল্ম ফোরামের সাথীকে দেখতাম, তাঁদের সঙ্গে খসরু ভাইয়ের আপাত বৈরী অথচ কোনো এক গভীর যোগ যেন তখনো বহমান ছিল। গাজী মাহতাব হাসান, তারেক আহমেদ বুলবুল, মান্নান এসকল বন্ধুদের দেখতাম খসরু ভাই ও শর্ট ফিল্ম ফোরাম উভয় কেন্দ্রেই যেন অবাধ অভিগম্য ছিলেন! এদের দেখে সেই নবীন আমার ঈর্ষা হতো-এই ভেবে যে - হয় এঁরা কোনোভাবে পথভ্রষ্ট, নয়তো কোনো বিশেষ ক্ষমতাবলে উভয় বলয়েই বিচরণক্ষম! আমার ধ্যানজ্ঞান তখন কোনোরকমে ক্যারিশম্যাটিক এইসব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ঐকান্তিক সান্নিধ্য পাওয়া, তাদের দিবারাত্রির কঠোর পরিশ্রম- কেবল সংগঠন ও নিজেদের আরাধ্য চলচ্চিত্রের কাজেই আত্মনিয়োগ-আমাদের কেমন যেন এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ’৮৮, ’৮৯ সাল তখন! নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিন পার করতাম ৪৬ নিউ এলিফ্যান্ট রোডের লন্ডন হাউসের নিচতলার স্যাঁতসেঁতে ছোট্ট ঘরে, প্রতিদিন প্রায়ই সেখানে গোল হয়ে বসতেন-তারেক শাহরিয়ার, মোর্শেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, এনায়েত করিম বাবুল, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, মানজারে হাসীন মুরাদ, আমিনুল ইসলাম খোকনসহ আরও অনেকে। তাদের আলোচ্য বিষয় তখন- হয় তারেক মাসুদের আদম সুরত কি আদৌ শেষ হবে? নয়তো, স্বৈরাচারবিরোধী কোনো সমাবেশে বা বিশেষ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনে কোথায় মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’র প্রদর্শনী করা সম্ভব! তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’র শো আবার কোন জেলায় হচ্ছে অথবা ‘স্টপ জেনোসাইড’! সামনের বছরই আসন্ন-২য় আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৯০। সে সময়ের সফল চলচ্চিত্র নির্মাদের সেই সামষ্ঠিক সহাবস্থান আমার নিদ্রাহরণ করেছিল, কবে আমিও পারব এঁদের মতো নিজের ফিল্ম তৈরি করতে! বয়স তখন নিতান্তই অল্প, সবেমাত্র স্কুল শেষ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। ততদিনে আমাদের নিজেদের ফিল্ম সোসাইটি গঠন করেছি সহপাঠী, বন্ধুরা মিলে-‘সত্যজিৎ রায় ফিল্ম সোসাইটি’। বন্ধু, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সংগঠক গোলাম রাব্বানী বিপ্লব ও আমিই মূলত প্রধান উদ্যোক্তা ছিলাম, আরও অনেক বন্ধু ও শুভান্যুধায়ীদের ভিড়ে। তখন থেকেই শুনতাম বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন এই মুহম্মদ খসরু। হয়তো কখনো-সখনো বন্ধুবর গাজী মাহতাব হাসান কানের কাছে মুখ লাগিয়ে সবার অলক্ষ্যে জানান দিত- আরে মিয়া এই যে যত্তগুলান মুরিদানকে দেখতাছো, এদের সক্কলের ওস্তাদ হইল গিয়া মুহম্মদ খসরু। আমার চলচ্চিত্র নির্মাতা হবার স্বপ্নে মগ্ন হৃদয়- তখন হাসানের সেসব ইঙ্গিতময় তথ্যে ঘোর অবিশ্বাসী।

ধীরে ধীরে তারেক শাহরিয়ার, এনায়েত করিম বাবুল, জুনায়েদ হালিম প্রমুখ অগ্রজদের উষ্ণ সান্নিধ্যের পরিণতিতে খসরু ভাইয়ের বিষয়ে খোলাসা হতে থাকে অনেক কিছু। তখন তাঁকে দেখে মনে হতো, যেন নিঃসঙ্গ কোনো এক শেরপা! কারও সঙ্গ ব্যতিরেকে যিনি কুঁজো হয়ে হয়তো টিএসসির দিকে একাকী মিলিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত গভীর রাতের আঁধারে। তখনো আলাপচারিতা হয়নি! ভেবেছিলাম অগ্রজদের যেভাবে গালি-গালাজ করছেন- কখনবা আমার ওপরই এসে বর্তায় তার বিখ্যাত সেসব বুলি! তাই ভয়ে কাছে ঘেষিনি। মনে করতে পারছি না, ঠিক কত বছর পর খসরু ভাইয়ের ভালোবাসা পেতে শুরু করি। একবার কি দু’বার, হয়তো হাসানের সঙ্গে বারে গিয়ে দেখা হয়েছে-দেখতাম হাসানকে খুব স্নেহ করতেন। হয়তো নিজের বোহেমিয়ান জীবনের অভেদ্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বাপ-মা মরা হাসানকে। আর হাসানও দেখতাম শর্ট ফিল্ম ফোরাম অফিস থেকে বেরিয়ে, তড়িঘড়ি ছুটছে-খসরু ভাইকে রাতের জলপান শেষে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে। এভাবেই মনে হয় দেখা হয়ে যায় কোনো এক সন্ধ্যায়। আমাকে শান্তশিষ্ট, হার্মলেস ক্রিচার হিসেবে এরমধ্যে নিশ্চয়ই হাসান উপস্থাপনের পালা শেষ করেছে তাঁর কাছে। প্রথম দেখাতেই জানলাম- তাঁর কোনো এক সিনেমা বিষয়ে হাসানের সঙ্গে পরিকল্পনা করে নিলেন কতক্ষণ। তারপর হয়তো আমার দিকে ফিরে জাহিদুর রহিম অঞ্জন, মানজারে হাসিন মুরাদ বা মোরশেদুল ইসলামকে দিলেন একগাদা স্পেশাল গালি। বোঝাই যাচ্ছিল কোনো এক কারণে এদের ওপর চরম ক্ষিপ্ত তিনি-যার রহস্য তখনো জানতে পারিনি। ধীরে ধীরে কতিপয় অগ্রজই খোলাসা করলেন সেসব রহস্য কিছু কিছু-যার অনেককিছুই পরে বুঝেছি-অর্ধসত্য-যার উল্টোপিঠের বিবরণ আরও পরে খসরু ভাইয়ের লেখা পড়ে ও তার কাছ থেকে শুনে জানতে পেরেছিলাম। যা হোক, যেহেতু ততদিনে শর্ট ফিল্ম ফোরামের অগ্রজদের কথা বেদবাক্যের মতো মানলেও সেই দুষ্টু গোয়ালের গরুর মতো হাসানের ডাকে কয়েকবারই গিয়েছি খসরু ভাই সন্দর্শণে। দেখতাম তিনি ব্যাগ থেকে একগুচ্ছ পুরনো স্ক্রিপ্টের ফাইল বের করে কী কী যেন বোঝাচ্ছেন হাসানকে। আর হাসানও ততক্ষণে ভবতারিণীর মতো ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’, ‘আরে বুঝলামতো’ এরকম নানাবাক্যে তাঁকে নিরস্ত করতেই চাচ্ছে। পরে জেনেছি- সেটি ছিল তাঁর বহু আরাধ্য-চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য-যা তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন সেই যুবা বয়স থেকেই-হাসান আজিজুল হক রচিত ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্প অবলম্বনে। এর জন্য অনুমতিও নেওয়া ছিল তাঁর- লেখকের কাছ থেকে। কেবল এই একটা ছবিই খসরু ভাই নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। পরে, অনেক বছর পর, আমিও কিছুদিন লেগেছিলাম তার এই ছবি তৈরির জন্য একটা প্রডিউসিং সাপোর্ট জোগাড়ের কাজে। আমাদের অনেকেরই সে চেষ্টা বিফল হওয়াও খসরু ভাই হয়তো শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন-তাঁর বয়সের ভারে-আর তা ঠিক তাঁকে নয়, আমাদেরই ঋজু করে দিয়েছিল ব্যর্থতার ভারে। অনেক পরে জেনেছি-ফিল্ম সোসাইটির যে আন্দোলন আমরা করেছিলাম-তা এদেশে এসেছিল তাঁরই হাত ধরে। সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ চলচ্চিত্রপ্রেমীর উদ্যোগে ভারতবর্ষের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ-ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি-আত্মপ্রকাশ করার অল্পকিছুকাল পরই এঁদের কর্মকাণ্ডে উদ্দীপিত হয়ে ওয়াহিদুল হক, মোশারফ হোসেন, কলিম শরাফি, আনোয়ারুল হক খান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখের পরামর্শ ও সাহচর্যে- মুহম্মদ খসরু নামে এক তরুণ বাংলাদেশে-পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি-নামে প্রথম চলচ্চিত্র সংসদটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৩ সালে, তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে এই চলচ্চিত্র সংসদ। আমি একবার তারেক মাসুদকে রহস্য করে বলতে শুনেছিলাম- ‘রাশিয়ার আধুনিক লেখকরা যেমন গোগলের ওভার কোট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন-আমরা আজকের এইসব ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকাররাও সব মুহম্মদ খসরু’র পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছি!’ আর এরাই পরবর্তীকালে, তাঁর সেই তীব্র রোষের শিকার হয়েছিলেন! বাংলাদেশ পরবর্তীকালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত-‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’ নাম বদলে হয়-‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’। এদের উদ্যোগেই সংগঠিত হয়েছিল - দেশের প্রথম স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ কো-অপারেটিভ। সদস্যদের চাঁদা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এ সংগঠনের মাধ্যমে - প্রথম স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণে- কো-অপারেটিভ ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল তিনি নিজে নন, বরং তাঁর সংসদের সদস্য-তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করবেন কো-অপারেটিভের উদ্যোগে নির্মিতব্য প্রথম চলচ্চিত্রটি- কবি নির্মলেন্দু গুণের ’হুলিয়া’ কবিতা অবলম্বনে- একই শিরোনামে। আর নির্মম সংবাদটি হলো, এ ছবিটি শেষ পর্যন্ত নির্মাণ সম্পন্ন হয় তানভীর মোকাম্মেলের নিজেরই উদ্যোগে এবং কো-অপারেটিভের বাইরে থেকেই। আর এর সঙ্গেই পরিসমাপ্তি ঘটে-মুহম্মদ খসরুর স্বপ্নের-যার রোল মডেল হতে পারতো বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি। নির্মাণ শেষে, তানভীর মোকাম্মেলসহ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ-আগ্রহী একদল তরুণ একত্রিত হয়ে গঠন করেন-বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম। আর নিয়তির বিচিত্র পরিহাসে-সেই আলমগীর কবিরই তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- যেভাবে তিনি এর আগেও মুহম্মদ খসরুর হৃদয় ভেঙেছিলেন-পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি পরিচালনায় মুহম্মদ খসরু অর্পিত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে মাত্র তিন বছরের মাথায় নিজের ভিন্ন একটা ফিল্ম সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে। তাই তিনি শর্ট ফিল্ম ফোরামের লোকদের সহজে পছন্দ করতেন না। ভাবতেন এরাই লুটে নিয়েছে তাঁর স্বপ্ন- যদিও বেলা শেষে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই মহান মানুষটির সুসম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়-শর্ট ফিল্ম ফোরামের সঙ্গে! এরা খসরু ভাইকে বাংলাদেশের সিনেমায় তাঁর সারাজীবনের অবদান স্মরণ করে -তাদের সর্বোচ্চ সম্মাননা- ‘লাইফ টাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ উপহার দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য-অনেকের মতো আমিও এই উদ্যোগের অংশীদার ছিলাম। 


২০০০ সালে ভাস্কর নভেরা আহমেদের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘ন হন্যতে’র পর ২০০৩ সালে আমার প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র-‘বিস্মরণের নদী’র নির্মাণ শেষ হয়। ছবিটা দেখানোর আগেই চিরবিদায় বরণ করেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতা-আমার চলচ্চিত্র দীক্ষা গুরু-তারেক শাহরিয়ার। তিনি শত কষ্টের জীবন পার করে সবে শুরু করেছিলেন তার আরাধ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ। তার নির্মিত ‘কালিঘর’ ছবিটি এর মধ্যেই ঘুরে এসেছে বেশ কয়টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। তারেক ভাই হাত দিয়েছিলেন-মধুপুরের ‘মান্দি’ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনের গল্প নিয়ে তার ‘আমা’ (মা) ছবির কাজে। কিন্তু সেই উত্তাল সময়েই নিভে গেল তাঁর জীবনপ্রদীপ। তারেক শাহরিয়ারের সঙ্গে কোনো বারে গেলে, দুপুরের দিকে মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যেত খসরু ভাইয়ের সঙ্গে। আমরা হঠাৎই আমাদের পূর্বতন পর্ব শেষ করে ভিড়ে যেতাম খসরু ভাইয়ের দলে। এভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলেছে আমাদের আড্ডা। রোজ দেখতাম, আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছেন মুহম্মদ খসরু। শুধু চলচ্চিত্র নিয়ে নয়, পৃথিবীর হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে খসরু ভাইয়ের বইয়ের সংগ্রহ ছিল না। জীবনে কখনো এভাবে বিচিত্র বই সংগ্রহ করে পড়তে দেখিনি কাউকে! দোকানে বা নীলক্ষেতের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে-বসেই সেসব বইয়ের অনেকখানি পড়ে ফেলতেন! আমাদের দেখা পেলে আর ছাড়তেন না। সবসময়ই তরুণদের ভালোবাসতেন খসরু ভাই। নিয়ে যেতে চাইতেন তাঁর বাসা পর্যন্ত। আর কোনোভাবে রুহিতপুরে গিয়ে পড়লেই হতো, ব্যাস, খাইয়ে দাইয়ে সিনেমার নস্টালজিক আলাপে মুখর করে তুলতেন আমাদের। বলছিলাম তরুণদের কথা! চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন বয়সের নবীন অনেকের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েই চলেছে। ওদের অনেকের অভিজ্ঞতায়ই শুনেছি, খসরু ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে, দিনের পর দিন তাঁর বাড়িতে থেকে যারা সেসব বই পড়তেন, তাদের মাথা থেকে সিনেমার ভূত কখনো আর নামেনি। পরবর্তীতে বিশুদ্ধ সিনেমার, শিল্পের চর্চায় সেসব নবীন আমাদের সাথী হয়েছেন। হয়তো খসরু ভাই কোনো এক বিচিত্র কারণে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছেন; কিন্তু সেই ভূত সে আর নামাতে পারেননি। এরা অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের মানস গঠনে খসরু ভাইয়ের সাধু-সঙ্গের ঋণ স্বীকার করেছেন। কেবল চলচ্চিত্র অনুরাগী হতে গেলে যে বিবিধ পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে- তাতো সেখানে থেকেই শিখেছিলেন তারা। এভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমরা খসরু ভাইয়ের কাছে ঋণী। কেবল চলচ্চিত্র নির্মাতা বা কুশলীরাই কি! খসরু ভাইয়ের গুণমুগ্ধ অসংখ্য চারুশিল্পি, লেখক, কবিরাও পেয়েছেন তার অমোঘ সান্নিধ্য-যার ঋণ তাঁরা চিরকাল স্বীকার করেছেন। যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে- কবি জুয়েল মাজহার, রাজু আলাউদ্দিন, চিত্রশিল্পী নিসার হোসেন, ওয়াকিলুর রহমান, ঢালী আল মামুন, শিশির ভট্টাচার্য, তৌফিকুর রহমান, কাজী মৃণাল, ভাস্কর রাসা, লেখক কবি, সমালোচক, সাংবাদিকদের মাঝে- আলম খোরশেদ, সাজ্জাদ শরীফ, তপন জ্যোতি বড়ুয়া, কাজল শাহনেওয়াজ, কাইজার চৌধুরী... এরাও ছিলেন খসরু ভাইয়ের স্নেহবলয়ে-তা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই বোঝা যেত। 

ষাটের দশকের প্রায় শুরু থেকেই অন্যান্য দেশের মতো পূর্বপাকিস্তানেও শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। মুহম্মদ খসরু ১৯৬৩ সালে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-ওয়াহিদুল হক প্রমুখের সঙ্গে মিলে প্রবর্তন করেন এদেশের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালকদের প্রদর্শনী ছাড়াও সেই সময়ে সিনেমাবিষয়ক নানান পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ, নিয়মিত পাঠচক্র আয়োজন, চলচ্চিত্র আলোচনা-সমালোচনার মতো বিষয়াদি তাদের তাৎক্ষণিক আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এসবকিছুর সঙ্গে মুহম্মদ খসরুদের মধ্যে আরেকটি গভীর দূরবর্তী ভাবনাও সেদিন কাজ করেছিল-তা হলো এদেশে সৎ ও স্বাধীন ছবি নির্মাণ এবং তার সঠিক মূল্যায়ন! তখন পর্যন্ত মুহম্মদ খসরুরা মধুর ক্যান্টিনে আলাপ-আলোচনা চক্রের পাশাপাশি, ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলে হলে ঘুরেছেন ছাত্রদের ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত সিনেমা প্রদর্শনী দেখার আহ্বান জানাতে- বিভিন্ন দেশের দূতাবাসসমূহের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে যার আয়োজন করে আসছিলেন তাঁরা।

১৯৬৬ সালে আলমগীর কবির যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে এলে, তদানিন্তন আইয়ুব সরকার তাকে কমিউনিস্ট মতাদর্শিতার আভিযোগে গ্রেফতার করে। কবির তাঁর অক্সফোর্ডে ফিজিক্স পড়া শেষ করে ততদিনে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় আন্দোলনের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সদস্য হয়ে চলচ্চিত্র চর্চা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালেই তিনি হলিডে পত্রিকায় চলচ্চিত্র সমালোচনা লেখা শুরু করলে, মোহাম্মদ খসরু তাঁকে অনুরোধ করেন পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির হাল ধরবার জন্য। মুহম্মদ খসরুর আহ্বানে আলমগীর কবির সম্মত হন ও সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তাঁরা নানান চলচ্চিত্র পাঠচক্র, আলোচনা, সেমিনার আয়োজন, বুলেটিন-সাময়িকী ইত্যাদি প্রকাশের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অব্যাহত রাখেন। বিশ্বের অন্যান্য চলচ্চিত্র সংসদের মতো বাংলাদেশেও সূচনা পর্ব থেকেই ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’ কাজ শুরু করেছিল-একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সামনে রেখে। নিয়মিত সৎ ও শিল্পসম্মত ছবি প্রদর্শন, চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র গ্রন্থাগার স্থাপন, চলচ্চিত্র সংরক্ষণাগার স্থাপন, চলচ্চিত্র শিক্ষায়তন স্থাপন, চলচ্চিত্র পুস্তক প্রকাশনালয় স্থাপন, চলচ্চিত্র উপলব্ধি সঞ্চারণ, সংসদ প্রেক্ষালয় স্থাপন, সৎ ও সৃজনধর্মী চলচ্চিত্রায়নে উৎসাহদান, চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিকতা (বিষয়ে) যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে আসছিলেন। ১৯৬৯ এ এসে আলমগীর কবির লায়লা সামাদকে সঙ্গে নিয়ে গড়লেন আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’-যেটি স্বাধীনতা পূর্বকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র সংসদ। এর কিছুকাল আগেই আলমগীর কবির ১৯৬৮ সালের মে মাসে ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখান থেকে ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন এ সার্টিফিকেট কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চলচ্চিত্র সংসদগুলো এদের কার্যক্রম শুধু চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশ ও শিক্ষায় চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ নানা দাবি-দাওয়া উপস্থাপনের ভেতরই সীমাবদ্ধ রাখেনি। প্রকাশ করেছিল নানান মুখপত্র। এদের মধ্যে, মুহম্মদ খসরু কর্তৃক সম্পাদিত ধ্রুপদী, আলমগীর কবির রচিত গ্রন্থ- দি সিনেমা ইন পাকিস্তান-উল্লেখযোগ্য। পরিসংখ্যান বলছে-১৯৭০ সাল পর্যন্ত সিকোয়েন্স এর তিনটি, ধ্রুপদীর দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এসব প্রকাশনায় দেশি বিদেশি ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের সমালোচনা, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ওপর রচনা, চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নিয়ে নানান রচনা, দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, চলচ্চিত্র কলার সঙ্গে শিল্পের নানা আঙ্গিকের সম্পর্কবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধাদি, চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন বিদেশি লেখার অনুবাদ, সেন্সরপ্রথাবিষয়ক বিভিন্ন রচনা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এই আন্দোলন অদ্ভুতভাবে বৈশ্বিক সিনেমার সাম্প্রতিকতম চলচ্চিত্র নির্মাণ ধারা-তথা নানান মহাদেশিক চলচ্চিত্র নির্মাণ অভিজ্ঞতা ও সেসব দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিল। মুহম্মদ খসরুর বর্ণনায়- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সিনেমা শিল্প কে প্রণোদনা জোগাড়ের জন্য সরকারি নানান প্রতিষ্ঠান কখন কি করছে সেসবের বিবরণ পাওয়া যায়। এনএফডিসি কর্তৃক শিল্পমান সম্পন্ন ছবির প্রযোজনা শুরু হওয়ার খবর, জাতীয় চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কর্মকাণ্ড, ফিল্ম আর্কাইভ গঠনের প্রয়োজনীয়তা, চলচ্চিত্র শিল্প রক্ষার্থে সরকারি নানান উদ্যোগের সমকালীন প্রয়োজনীয়তার খবরাখবরসহ, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা প্রকাশে তাদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদিও এসব প্রকাশনায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। 


লক্ষ্যণীয় বিষয়, আমাদের নিজস্ব ভিন্ন দেশ গঠনের প্রক্রিয়ার সময় থেকেই এই অঞ্চলের চলচ্চিত্রের গতিপ্রকৃতি- দেশ, মানুষ এবং পারিপার্শ্বিকতা নির্ভর ‘চলচ্চিত্র শিল্প’ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হোক- এটাই চেয়েছিলেন সেকালের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মীরা। হতাশার কথা আমরা সেপথে হাঁটিনি- যদিও অন্যান্য মহাদেশিক শক্তি তাদের নিজস্ব চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সে সুবাতাস তাদের চলচ্চিত্র নির্র্মাণের ধারায় বইয়ে দিতে পেরেছিল।

১৯৭৫ সালে মুহম্মদ খসরুর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’, ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় ‘চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণ কর্মশালা’ আয়োজন করে। চলচ্চিত্র গবেষক, লেখক ও নির্মাতা সাজেদুল আউয়ালের বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন সংক্রান্ত গবেষণা থেকে জানা যায়, ‘...১৯৭৫ সালে মুহম্মদ খসরুর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’ ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় আয়োজন করে- পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সতীশ বাহাদুরের পরিচালনায়, তিন সপ্তাহব্যাপী ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স। এই কোর্সের সফল পরিসমাপ্তিই এদেশে ফিল্ম আর্কাইভ গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’ (স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’ এর পরিবর্তিত নাম) প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের’ একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় এবং ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’ এর উপর্যুপরি দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই, ১৯৭৮ সালে এদেশে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যান্ড আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে...’ সংসদ কর্মীরা অবশ্য আর্কাইভ ও ইনস্টিটিউট একত্রে স্থাপনের পক্ষপাতি ছিলেন না। সাজেদুল আউয়ালের মতে, পূর্ব পাকিস্তান পর্বেই- ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ চলচ্চিত্র সংরক্ষণাগারের কথা তুলেছিল, যা বাংলাদেশ পর্বে এসে ফিল্ম আর্কাইভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। 

’৭০-এর দশকে, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের আরেকটি বিস্তার ঘটেছিল। এই দশকেই চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা চলচ্চিত্র শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন দেশের ফিল্ম ইনস্টিটিউটগুলোতে। ফিরে এসে তারাই চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত হন। নানান কর্মশালা ও এপ্রিসিয়েশন কোর্স করানোর পাশাপাশি-বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে অনেকে শিক্ষক হিসেবেও যোগদান করেন। সংসদের উদ্যোগে এ সময় থেকেই অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্রবিষয়ক নানান ওয়ার্কশপ, সেমিনার, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রেট্রোস্পেকটিভ সেশন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে ৬ মাসব্যাপী ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স প্রচলিত হয়। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন বিভাগে পড়ে এসে-সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, শফিকুল ইসলাম স্বপন, সাইদুল আনাম টুটুল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ ব্যক্তিত্ববর্গ এসব কোর্সের শিক্ষকতায় যুক্ত হন।    

১৯৭৬ সালে এসে একটি লক্ষণীয় বিষয় দেখা যায়, ফিল্ম সোসাইটিগুলোর বিভাজন রোধে সরকার অগ্রণী হয়ে নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে সুসংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসে-যা শেষ পর্যন্ত আর প্রণীত হয়নি। এরপরের ইতিহাস আরও হতাশাব্যঞ্জক! শুরু হয় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ বিধি বাস্তবায়নের কাজ। ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই, জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘চলচ্চিত্র সংসদ রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ আইন’। এ আন্দোলনের কর্মীরা যাকে বলে থাকেন ফিল্ম সোসাইটি কালাকানুন- তাঁদের দাবি,  ফলে ‘বাংলাদেশ পর্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের গতি যায় মন্থর হয়ে।’

১৯৮০-৮১ সালের দিকে যখন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের’ চলচ্চিত্র নির্মাণ সমবায়ের তহবিলে বার্ষিক সদস্য চাঁদা জমা হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা মতো, তখনই সমবায়ের সদস্যরা একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এ সময় তানভীর মোকাম্মেল তাঁর ‘হুলিয়া’ ছবিটি করার আগ্রহ প্রকাশ করলে, ‘বাংলাদেশ ফিল্ম কো-অপারেটিভ’ এর উদ্যোগে ছবিটির শুটিং শুরু হয়। তবে শুটিং অনেকটা এগিয়ে যাবার পর প্রযোজনা সংস্থা ও চলচ্চিত্র নির্মাতার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে শেষ পর্যন্ত তানভীর মোকাম্মেল কোঅপারেটিভের লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত দিয়ে-নিজেই ছবিটি প্রযোজনা করেন। সংসদের তৎকালীন সক্রিয় সদস্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারে হাসিন স্মৃতিচারণ করছেন এভাবে- ‘....সংসদের চলচ্চিত্র নির্মাণের এই উদ্যোগ সফল হলে আজ বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এদেশে-বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের-পথিকৃতের ভূমিকা স্বীকৃত হতো।’ 

চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের এই দীর্ঘকালীন কর্মস্রোতে দেশি-বিদেশি বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাত্ত্বিকবৃন্দ খসরু ভাইয়ের সংস্পর্শে এসেছেন, তার সঙ্গে গড়ে উঠেছে তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী সুদৃঢ় বন্ধুত্ব। আমার মনে আছে ১৯৯৪ সালে, শর্ট ফিল্ম ফোরামের সদস্য হিসেবে একবার ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিনিধি অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে যখন অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড সংগ্রহ করতে ওদের অফিসে যাই- তখন একদল বয়োজ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্রকর্মী আমাদের দেখে আপ্লুত হন এবং বারবার ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করতে থাকেন - মুহম্মদ খসরু কি এসেছেন! জানলাম, বিগত উৎসবে এসেছিলেন তিনি। ফাদার গাস্ত রোবের্জ এর চিত্রবাণীতে অতিথি হিসেবে থেকেছিলেন ফাদারের আমন্ত্রণে। নির্ঘাত তখনই তাদের সঙ্গে পুনর্মিলন হয়েছিল। তাই অমন করে সান্নিধ্যের আকর্ষণেই খুঁজছেন তাঁকে। তাঁর সাহচর্য অতটাই প্রিয় হয়ে উঠেছিল তাদের কাছেও! 

দীর্ঘকালীন এই কর্মময় জীবনে, বাংলাদেশে আগত বিদেশি নানান বিদগ্ধ কবি, লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল তাঁর। সে বন্ধুত্ব আজীবন টিকিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে-প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা আদূর গোপালা কৃষ্ণান, ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস লি, চলচ্চিত্র শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী সতীষ বাহাদুর, লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহজী এন, কারুণ, বরেণ্য নির্মাতা রাজেন তরফদার- যার পালঙ্ক ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালনাক হিসেবে কাজ করেছিলেন, হৃত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক ও ছেলে ঋতবান, চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়, ভারতের জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের কিউরেটর- পিকে নায়ার প্রমুখের কথা। তাদের সঙ্গে নিয়মিত চিঠি-পত্রের যোগাযোগ ছিল তাঁর। এখানে মুহম্মদ খসরুকে লেখা নানা বিশিষ্টজনের কয়েকটি চিঠির অংশ-বিশেষ উল্লেখ করছি। এসব পত্রালাপ থেকে দেশে চলচ্চিত্র বিকাশে তাঁর বিচিত্র উদ্যম ও অভূতপূর্ব প্রচেষ্টার সংশ্লিষ্টতা খানিকটা পরিব্যপ্ত হবে।

পালংক ছবির পরিচালক-রাজেন তরফদার 

ভাই খসরু, তোমার চিঠি কদিন হলো পেয়েছি; কিন্তু পালঙ্ক নিয়ে সবিশেষ ব্যস্ত থাকায়, Certificate পাঠাতে দেরী হয়ে গেল। মনে কিছু কোরো না। পশ্চিম বঙ্গে Electric power crisis জনিত Load Shedding -এর দৌরাত্ম্যে পুরো Negative Editing January -তে শেষ হওয়া সত্ত্বেও কিছু দিন বন্ধ রাখতে হয়েছিল। অধুনা আবার বাকী কাজ চালু করা হয়েছে। কাল Background Music শেষ করা গেল। শুধু তথাকথিত ভেঁপু বাজান Music নয়- চার দিন ধরে বেশ নতুন কিছু Experiment করা গেল। নতুন আস্বাদন মিলবে। এ মাসের শেষে Bombay যাব  Re- recording I Optical কাজ করতে। Power Crisis এখনো Normal নয়, তাই Bombay পাড়ি দিতে হচ্ছে। পালঙ্ক নিয়ে বাংলাদেশে নানা জটিলতার সৃষ্টির প্রয়াস হচ্ছে- সেখবর আমিও রাখি। এমনকি আমাদের সমস্যা পূর্ণভাবে অবহিত করা সত্ত্বেও, ওখানকার প্রযোজক সংস্থা India Government-এর কাছে বিষয়টি কদর্য্যভাবে উপস্থিত করছেন। যৌথ কারবারে শামিল হয়ে, যেখানে একের সমস্যা অন্যের হওয়া উচিৎ সেখানে সন্দেহে অনুপ্রাণিত হওয়া, সত্যিই দুঃখজনক। যাই হোক, মনে হয় August মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে ছবি দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারব আমরা। Joint Venture-এর খবর চেয়েছো- এই মুহূর্তে সঠিক জানাতে পারছি না- পরে জানাব। 

ইতি
রাজেন তরফদার

সত্যজিৎ রায়ের লেখা ১.১১.১৯৭৪ সালের চিঠি

শ্রী মুহম্মদ খসরু সমীপেষু

সবিনয় নিবেদন,

আপনার সেপ্টেম্বর ১০-এর চিঠি দু’দিন আগে (অক্টোবর ৩০) পেলাম। আগের চিঠিটা পাইনি বলেই মনে হচ্ছে, কারণ ডাকের গোলমাল অনেক দিন থেকেই শুরু হয়েছে। আমি গত দু’মাস অপেক্ষাকৃত মুক্ত ছিলাম এখন আবার কাজে জড়িয়ে পড়ছি। এ অবস্থায় কোনো প্রবন্ধ লেখা সম্ভব হবে না। এমনিতেও আমি আগামী সপ্তাহে প্রায় ১০-১৫ দিনের জন্য কলকাতার বাইরে চলে যাচ্ছি। তাছাড়া ডিসেম্বরে দিল্লি যেতে হবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে। আপনারা ’৭৫-এর মে মাসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ধ্রুপদীর পরবর্তী কোনো সংখ্যার জন্য একটা লেখা দিতে পারি। 

নমস্কারান্তে 
ইতি- সত্যজিৎ রায়

২৫.৩.১৯৭৯ রোম ইটালি থেকে খসরু ভাইকে লেখা- শামসুদ্দীন আবুল কালামের চিঠির কিয়দংশ-

‘...মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনির লেখার অনুবাদ, তাঁর আপনাদের উৎসর্গ করা ছবি পাঠালাম। আন্তোনিয়নী সম্পর্কে আমার কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এখনই সম্ভব করে উঠতে পারলাম না। বারতুলুচ্চিকে খুঁজে পাচ্ছি না, সম্ভবত এদিক-সেদিক ঘুরে-ফিরে বেড়াতে ব্যস্ত। রোম ফিরে এলে তাঁর কাছ থেকে আপনাদের জন্য লেখা আদায় করবোই। আগামী সপ্তাহে আলবার্তো মোরাভিয়াকে ফোনে অনুরোধ জানাব। তার সহধর্মিণী দাচায়া মারাইনীর লেখাও যদি চান, পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারি...’ 

অজস্র শুভ কামনাসহ
আপনাদের শামসুদ্দীন আবুল কালাম

২.৬.৮১-তে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি-

প্রিয় খসরু, তোমার কাছে আমি খুবই লজ্জিত। যাই হোক কোনো ক্রমে একটি ছোট লেখা পাঠালুম। ...ভালো আছো নিশ্চয়ই। বেলাল নতুন চাকরিতে ঢুকেছে শুনলুম। বটু কেমন আছে? তোমাদের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সেই এক সঙ্গে নদী পথে বেড়াতে যাবার কথা কোনো দিন ভুলবার নয়। আমাদের দেশের অবস্থা খুব খারাপ। তোমাদের অবস্থাও ঈর্ষণীয় নয়। পৃথিবীটা দিন দিন এমন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে কেন? দুঃখে ঘৃণায় আমি আর কোনো রাজনৈতিক খবরই পড়ি না। স্বাতীকে নিয়ে আমি কয়েকটি সাহেবদের দেশে বেড়াতে যাচ্ছি আগামী মাসে। চার পাঁচ মাস বাদে ফিরবো। আগামী বছর তোমাদের ওখানে যাবার ইচ্ছে রইলো। 

ভালোবাসা জানাই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটকের ছেলে ঋতবানের লেখা চিঠি

প্রিয় খসরু চাচা, 

খুবই অবাক হয়েছ নিশ্চয়ই! বর্তমানে আমি ও মহেন্দ্র ভাই, সিকদার আমিনুল হকের বাসায় উঠেছি। তোমার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে দেখা করা খুব তাড়াতাড়ি দরকার। কাল সকাল ৯টায় আমরা F.D.C. যাব। যদি পার তো কাল সকালে আসলে ভালো হয়, নইলে F.D.C.-তে Phone করলেও (Lab Incharge) আমাকে পেতে পার। আমি যেখানে উঠেছি সে বাসার Phone No. 500666, Sikder Amnul Haque, 68 New Elephant Road, 2nd Floor. (Opp-Coffee House), Dhaka-5

তোমার অপেক্ষায় রইলাম, ভালোবাসা
ঋতবান

এমনি সতীষ বাহাদূর থেকে শুরু করে কতো যে চিঠির সংগ্রহ অনেক দিন দেখেছি তাঁর জমে থাকা স্মৃতির তল্পিতে।  


চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনই বাংলাদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের তথা স্বাধীন চলচ্চিত্র চর্চার সুতিকাগার। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মকাণ্ড তাই আপাত দৃষ্টিতে একটি রুচিশীল দর্শকশ্রেণি ও সমাজ-বাস্তব ও শিল্পমানসম্পন্ন সিনেমার প্রতি সকলের আগ্রহ তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও- এর মাধ্যমেই উত্থিত হয়েছিল দেশে উন্নত চলচ্চিত্র সংস্কৃতি ও এখাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির দাবিদাওয়া। চলচ্চিত্র সংসদগুলোর নিয়মিত-অনিয়মিত প্রকাশনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সরকারি-বেসরকারি মহলে এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে দেনদরবারও তাই নিয়মিত ভাবে চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কর্মকাণ্ডকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছিল। আর এ আন্দোলনের কর্মীরাই গড়ে তুলেছিলেন দেশের স্বাধীন, শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ ও বিকল্প উপায়ে তা দর্শকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর আন্দোলন। 

তাইতো, খসরু ভাইয়ের প্রয়াণে তাঁর ফিল্ম সোসাইটির উদ্যম যাত্রাংশের সহচর চলচ্চিত্র নির্মাতা শামীম আখতার লিখেছেন- 

খসরু ভাই আমাদের যা দিয়েছিল তা হলো একটি অমূল্য পরিসর, যেখানে আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনাগুলোর প্রতাপে বেড়ে ওঠা। তার ঘর, তথা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ কার্যালয়, সত্তর দশকের মাঝামাঝি আমাদের পাঠশালা, চলচ্চিত্র যে পাঠের বিষয় সেই প্রথম বোঝা। ওখানেই আমাদের স্ক্রিপ্ট লেখায় হাতে খড়ি, বাঘা বাঘা চলচ্চিত্রকারদের নাম-ধাম, বিশেষত্ব বোঝা, আর যে লেখাগুলোর সুবাদে আমাদের চলচ্চিত্র রিভিউয়ে হাত পাকানো, পরিচিতি, নাম কামানো, সব কিছু ওই পরিসরের আনুকূল্যে। সিনেমা দেখা আর করার মধ্যে যে মাঝখানের একনিষ্ঠ অনুশীলন ব্রতচারীর একাগ্রতা দাবি করে, সেই দিক্ষা ওখান থেকেই পাওয়া। ওটাই তখন আমাদের মগজে বপন করা হয়েছিল। ফিল্ম ইনস্টিটিউট আর আর্কাইভ এর নীলনকশা নিয়ে তোড়জোর, দিনরাত্রি একাকার করে ভাবা, এসবের সাক্ষী কাল। খসরু ভাই বিগত হয়েছেন, রেখে গেছেন এইসব স্মৃতি তর্পন। আজ ইনস্টিটিউট আর আর্কাইভ হয়েছে, আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীর অভাব নেই, শিক্ষকও হাতের কাছে। অভাব মুহাম্মদ খসরুর সেই পরিসরের, যা অনুশীলিত নির্মাতা হবার প্রাথমিক শর্ত। আমরা সেই অভাবটা বড্ড তীব্রভাবে অনুভব করছি এই সময়ে।

এভাবেই খসরু ভাই বুড়িয়ে যাচ্ছিলেন। মেলেনি তাঁর ভাবনার সময়োপযোগী স্বীকৃতি। শেষ সময়গুলোতে দেখেছি, শুনে খুব আপ্লুত হতেন- বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খুব ইচ্ছা হতো, বার বার আমাকে বলতেন, কোনোভাবে যদি একটু ব্যবস্থা করা যায়- এইসব ফিল্ম নিয়ে পড়তে আসা তরুণ তুর্কিদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর! এমন কি কোনো সুযোগ তাঁকে দেওয়া যায় না, এই এদের সঙ্গে নিয়ম করে প্রতি কোর্সে যদি কয়েকবার গল্প করতে বসতে পারতেন! কি শেয়ার করতে চেয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে? নিজের জীবনের সেই উদ্যাম তারুণ্যের মুহূর্তগুলোকে- যা তিনি অবলীলায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই অভাগা দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে!

লেখক : এন, রাশেদ চৌধুরী

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগঠক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //