তাদের কথা কি কেউ মনে রাখবে

তাদের কথা কি কেউ মনে রাখবে, একাত্তরে যারা যুদ্ধ করে এবং প্রত্যক্ষ যুদ্ধে না গিয়েও প্রাণ হারিয়েছেন? প্রশ্নটা দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগকারীদের অনেকেই তুলেছেন, যারা তোলেননি তাদের মনের মধ্যেও থাকার কথা, অস্পষ্টভাবে হলেও। জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, রাখবে; অন্য কেউ না রাখুক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাদেরকে মনে রাখবে, যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কোনো দিন লেখা হয়। 

কথাসাহিত্যিক শঙ্করী দাস ওই ইতিহাসেরই উপাদান সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছেন তার বই ‘গণমানুষের স্মৃতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ নামের দুই খণ্ডে প্রকাশিত একটি বইতে। 

তার কাজটা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না, এবং ভেতরে প্রেরণা না থাকলে কোনো মতেই করা সম্ভব হতো না। প্রেরণার প্রথম উৎস এটা যে মুক্তিযুদ্ধে তিনিও ছিলেন, ছিল তার পুরো পরিবারও। ‘গণমানুষের স্মৃতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের প্রথম খণ্ডটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তার প্রয়াত শাশুড়ি, মা ও পিসিমা-কে, যারা তিনজনই শহীদজননী। ওই খণ্ডর শুরুতে ‘আমার কথা’-তে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যুদ্ধকালের নয় মাস তিনি দেশের ভেতরই ছিলেন, ছিলেন উদ্বাস্তু হিসেবে, এবং হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের বীভৎসতা একেবারে সামনাসামনি দেখেছেন। অসহায়, উৎপীড়িত মানুষের হাহাকার ও ক্রন্দন তিনি শুনেছেন। সন্দেহ নেই যে তার নিজের স্মৃতিচারণও এই বইয়ের অংশ হতে পারত। 

স্মৃতিকথা সংগ্রহ ও সম্পাদনায় তার অনুপ্রেরণার দ্বিতীয় উৎসটা হচ্ছে তার দায়বদ্ধতা। তিনি দায়বদ্ধতা অনুভব করেছেন ইতিহাসের কাছে; যার অর্থ তাদের কাছে যুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছেন, লড়াই করেছেন, অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, এবং সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতি ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেননি। সর্বোপরি দায়বদ্ধতা ছিল যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মৃতির কাছে।

প্রত্যক্ষ লড়াইতে ছিলেন আহসানউল্লাহ শেখ গোলাপ, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “আমার শরীরে মোট চারটি গুলি বিদ্ধ হয়। একটি বের করা হয় মুক্তিযোদ্ধা হসপিটালে। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২। বাকি তিনটি বুলেট আমার শরীরের ভেতর। একটি বুকে। দুটি ডান পাঁজরে। সেগুলো প্রতি রাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের জানান দেয়।” তিনি মোটেই একা নন, লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা আহত হয়েছেন, আপনজনকে হারিয়েছেন, ঘরবাড়ি খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের স্মৃতির ভারই ওই রকমের দুঃসহ। এবং সকলের মনেই একই প্রশ্ন, সেটি তারা বলুন কি না-ই বলুন; “স্বাধীনতার অর্থটা কী দাঁড়িয়েছে?” সংলগ্ন আরও একটি প্রশ্নও রয়েছে : “আমাদেরকে কি কেউ মনে রাখবে?”

শঙ্করী দাস তার নিজের তাগিদেই সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজটি করেছেন; এবং করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। স্মৃতিচারণের জন্য ব্যক্তিনির্বাচন, তাদেরকে খুঁজে বের করা, যোগাযোগ স্থাপন এবং তাদেরকে কথা বলতে সম্মত করানো, প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল দুঃসাধ্য। সবচেয়ে কঠিন ছিল শেষ কাজটা, ভুক্তভোগীদেরকে তাদের দুর্ভোগের কথা বলতে রাজি করানো। দুঃখের, অপমানের, যন্ত্রণার যে স্মৃতিকে তারা ভুলে থাকতে চেয়েছেন, সেগুলোকে খুঁড়ে বের করতে অনেকেরই কোনো আগ্রহ ছিল না। কেউ কেউ ফিরিয়ে দিয়েছেন, কেউ-বা কেঁদে ফেলেছেন, বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শঙ্করী দাস হাল ছাড়েননি। লেগে থেকেছেন। এবং বক্তারা যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবেই তাদের মুখের ভাষাতেই, কাহিনিকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন। 

মানুষগুলো প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। অভিজ্ঞতার মিল থাকলেও দুঃখ তো ভিন্ন ভিন্ন। সমাজে এদের অবস্থানও অভিন্ন নয়। কেউ কেউ অত্যন্ত দরিদ্র, কারও কারও অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই। ভিন্নতা ধরা পড়ছে বক্তব্যের ধরনে, বলবার ভাষাতে; এমনকি কণ্ঠস্বরেও; কিন্তু সবাই মিলে একই কথা বলেছেন। তারা জানতেন না কোন বিপদ আসছে। যুদ্ধের জন্য কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছিল না। কেউ কেউ শুনেছেন একটা গণ্ডগোল হতে পারে। কারও কারও ধারণা এই পর্যন্ত ছিল যে যুদ্ধ একটা হয়তো হবে তবে সেটা ঢাকায়। কিন্তু হানাদাররা তো বাংলাদেশে এমন কোনো জনবসতি ছিল না যেখানে গিয়ে হানা দেয়নি। তাদের কাজটা ছিল একই ধরনের। গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢোকা, আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি, এমনকি সমস্ত গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা। পলায়নপর মানুষকে গুলি করে হত্যা করা। মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া। এবং যেখানে যা আছে লুণ্ঠন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে হানাদারদের নৃশংসতা। সমস্ত দেশজুড়ে তারা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। শহরের চেয়ে গ্রামেই অত্যাচার ছিল বেশি। 

কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। রাখাটা সম্ভবও ছিল না। লাঞ্ছিত নারীদের ব্যাপারেও সেটা সত্য। নয় মাস জুড়ে বিশেষভাবে বিপদ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের, এবং ধর্মনির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মেয়েদের। হিন্দু মেয়েরা ছিলেন তিনভাবে বিপন্ন; বাঙালি হিসেবে, হিন্দু হিসেবে এবং নারী হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন, এবং বহুসংখ্যায় প্রাণ দিয়েছেন। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আমরা জিতেছি। হানাদাররা হেরেছে। আত্মসমর্পণ করেছে। বলা যায় পলায়ন করেছে। এই যুদ্ধকে কেউ কেউ বলেছেন গৃহযুদ্ধ। সেটি যুদ্ধের অবমূল্যায়ন বৈ নয়। স্বাধীনতার যুদ্ধ বললেও এর যথার্থ পরিচয় দেওয়া হয় না। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ, এবং এর চরিত্র ছিল জনযুদ্ধের। মুষ্টিমেয় কিছু বিশ্বাসঘাতক ও সুবিধাবাদী ছাড়া এই যুদ্ধে বাংলাদেশের সকল মানুষ কোনো না কোনোভাবে অংশ নিয়েছেন। প্রবাসীরাও লড়েছেন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে। এ যুদ্ধ ‘আমাদের’ যুদ্ধ; বিশেষ কোনো শ্রেণির নয়, সম্প্রদায়ের নয়, দলের তো নয়ই। ক্ষুদ্র জাতিসত্তারও; তাদের উপস্থিতির সংবাদও শঙ্করী দাসের বইতে রয়েছে। 

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সমস্ত দেশজুড়েই আরও একটা যুদ্ধ চলছিল; যেটা হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ। স্মৃতিচারণে সে-কথাটাও প্রত্যক্ষরূপে আছে। কেননা বেঈমান হানাদাররা যেটা শুরু করেছিল সেটা কেবল যুদ্ধ নয়, গণহত্যাও। তাদের দিক থেকে গণহত্যাই; আমাদের দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ। উনিশশ একাত্তরের বাংলাদেশে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সেই সঙ্গে চলেছে অবিশ্বাস্য ধরনের নারী-ধর্ষণ। ধর্ষণ ছিল একাধারে বিনোদন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ। প্রতিরোধ যত বেড়েছে ততই তেতে উঠেছে হানাদারদের প্রতিশোধ-স্পৃহা, যোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে শোধ তুলেছে অসহায় নারীদের ওপর। জোরটা ছিল বন্দুকের। 

আর এ কাজে পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিল পূর্ববঙ্গে নিয়োজিত হানাদার বাহিনীর প্রধান; স্বঘোষিত ব্যাঘ্র, আসলে পাষ-শ্রেষ্ঠ, এ এ কে খান নিয়াজী। নিয়াজীর আগে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন খাদিম হোসেন রাজা নামে এক মেজর জেনারেল। তিনিও পাঞ্জাবি, তবে তুলনায় কিছুটা কম উগ্র, যে জন্য তাকে সরিয়ে দিয়ে নিয়াজীকে আনা হয়েছিল। খাদিম হোসেন রাজার কাছ থেকে দায়িত্বভার গ্রহণের অনুষ্ঠান-শেষে খাদিম হোসেনকে নিয়াজী বলেছিল, যুদ্ধ তো চলবেই, কিন্তু খাদিম হোসেন যেন তার বাঙালি গার্লফ্রেন্ডদের ফোন নম্বরগুলো তাকে দিয়ে যায়। খাদিম হোসেন রাজা তার বইতে লিখেছেন, তার জন্য ওই কথাগুলো ছিল বজ্রাঘাতের সমতুল্য। তিনি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষেই সেটা হওয়ার কথা বৈকি। কিন্তু ওই রকমের কাজ করতে পারবে বলেই তো নিয়াজীকে আনা হয়েছিল। এবং নিয়াজী আর কী করবে, নিজের ওই আদর্শ তুলে ধরেছে তার সৈন্যদের কাছে। এবং সৈন্যরা সেনাপতির পথ ধরেই এগিয়েছে। বন্দুক হাতে।

যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে নিয়াজী আরও একটি ঘোষণা দিয়েছিল। বলেছিল যে বাঙালির জাতিপরিচয় সে বদলে দেবে। অর্থাৎ ধর্ষণের মহোৎসব বসাবে। খাদেম হোসেন রাজা জানাচ্ছেন যে ঘটনাস্থলে কয়েকজন বাঙালি অফিসার উপস্থিত ছিলেন; দম্ভোক্তিটি শুনে তাদের একজন ওয়াশরুমে গিয়ে পিস্তলের সাহায্যে আত্মহত্যা করেন। পারলে যুদ্ধে যেতেন, অনেকে যেমন গেছেন; কিন্তু সম্ভব ছিল না দেখে আত্মহত্যা করেন। 

রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য, জামায়াত ও মুসলিম লীগপন্থিদের ভূমিকাও ভুলবার নয়। সাক্ষাৎকারদানকারীরা ভোলেননি। রাজাকারদের কেউ কেউ জীবন ও জীবিকার দায়ে দলে নাম লিখিয়েছিল এটা সত্য, কিন্তু তাদের সকলেরই ভূমিকা ছিল হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতার। হানাদাররা বিদেশি, তারা পথঘাট চিনত না। আগবাড়িয়ে রাজাকাররা তাদের নিয়ে এসেছে। উচ্ছিষ্টভোগী হয়েছে। লুণ্ঠন করেছে। সুযোগ পেলে ধর্ষণেও পিছপা হননি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে তাতে হানাদারদের নৃশংসতা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, লক্ষ লক্ষ মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণা, এসব তো থাকবেই, থাকবে রাজাকারদের দালালির খবরও। যুদ্ধশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল না; সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল রাজাকারদের তালিকা তৈরি করার। তাহলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটাও তৈরি হয়ে যেত। কারণ রাজাকার বাদ দিলে বাকি যারা থাকতেন তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। শঙ্করী দাসের বই সে-কথাটাই বলছে, স্মৃতিচারণ করা প্রত্যেকটি মানুষই সে-কথাটা বলেছেন। 

যুদ্ধটা ছিল পূর্ববঙ্গের সকল মানুষের; শঙ্করী দাস বলেছেন, এটা আমাদের গণযুদ্ধ; সে-বর্ণনা সম্পূর্ণ সঠিক। সেই সঙ্গে যুদ্ধটা আবার ছিল স্বতঃস্ফূর্তও। কোনো প্রকার পূর্বপরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছিল না। না মানসিক না সামরিক। কেউ সতর্ক করে দেয়নি। কী করতে হবে জানায়নি। অস্ত্রশস্ত্র তো ছিলই না। বাঁশের লাঠি দিয়ে মেশিনগানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় কি? দাঁড়ানোর চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু তাতে শুধু প্রাণক্ষয়ই ঘটেছে, অপরিমেয়। নেতৃত্ব ছিল অনুপস্থিত। প্রবাসী সরকার যুদ্ধ-পরিচালনার দায়িত্বে ছিল; কিন্তু তারাও পরিষ্কারভাবে জানত না এই যুদ্ধের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যটা কী। হানাদারদের হটাতে হবে, সেটা তো সবাই জানত। না হটাতে পারলে বাঁচার যে কোনো উপায় নেই সেটাও কারও অজানা ছিল না। কিন্তু তারপর? তারপর মানুষ কি মুক্তি পাবে অভাব-অনটন থেকে? কীভাবে? নেতৃত্বের কাছ থেকে এসব ব্যাপারে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। আলবার্ট দ্রং বাঙালি নন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একজন যুবক। হানাদারদের নৃশংসতার মুখে মুক্তিযুদ্ধে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন ক্যাম্পে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলছেন যে, প্রবাসী মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী দলবল নিয়ে একদা এসেছিলেন তাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে। আলবার্ট দ্রং জানাচ্ছেন তার অভিজ্ঞতা-“মন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন তোমরা যুদ্ধ কর। রাজাকারদের সব সম্পদ তোমাদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হবে। মন্ত্রীর কথায় যোদ্ধাদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কেননা সম্পদের লোভে বা কোনো সুবিধা নিতে যুদ্ধে যাইনি।” মন্ত্রীদের ধারণা আর যোদ্ধাদের ধারণার মধ্যে ঐক্য ছিল না। এ ক্ষেত্রে নয় শুধু, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই। 

হানাদার বাহিনীর লোকদেরকে যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসা হয়েছিল সেই কাজের পেছনে যে উদ্দেশ্যের কথা রক্তলোলুপ সেনাপতিরা বলেছিল সেটা হলো হিন্দুনিধনের কর্তব্য। ওই লোকেরা এসে যখন দেখে হিন্দুরা পলাতক, মুসলমানদেরকেই শুধু দেখা যাচ্ছে, এবং এই মুসলমানরা খাঁটি মুসলমান বটে, তাদের চাইতেও খাঁটি, তখন তাদের মনোবল ঠিক রাখবার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, লুণ্ঠন করো, ধর্ষণও করতে পারো। বাধা নেই। তাই বলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্পদ ও সুবিধার আশা দিয়ে অনুপ্রাণিত করা! এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। পাকিস্তানি পাষণ্ডরা বুঝে ফেলেছিল যে পরাজয় অনিবার্য। তাই তারা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। মানুষ চাই না, মাটি চাই, এই ছিল হুকুম। সেটাই কার্যকর করা হচ্ছিল। আর তার ফলে পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে তা বর্ণনার বাইরে। স্মৃতিচারণ করেছেন যারা তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যই ওইটি। বোঝানো যাবে না, ভাষায় কুলাবে না, কল্পনা হার মানবে বাস্তবের কাছে। তাদের বলা না-বলার মধ্য দিয়ে যে সত্যটা বের হয়ে এসেছে সেটা হলো এই যে, বেশির ভাগ মানুষই কল্পনাতে বিজয়ের দৃশ্য দেখেননি, শুধু বাঁচবেন কি বাঁচবেন না চিন্তা ছিল সেটাই। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত ছিল আতঙ্কে ভরা। পালাচ্ছেন, দৌড়াচ্ছেন, লুকাচ্ছেন, অনাহারে থাকছেন, আশ্রয়হীন হচ্ছেন; মূলকাহিনি এটিই। সেটা যুদ্ধেরই অংশ, স্বাধীনভাবে বাঁচার যুদ্ধের। 

এমনিতেই পূর্ববঙ্গের দারিদ্র্য ছিল অসহনীয়। জনপদটি ছিল প্রান্তবর্তী ও নিষ্পেষিত। তার সম্পদ বিদেশিরা ধারাবাহিকভাবে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। পাচার করে দিয়েছে নিজেদের দেশে। একাত্তরেও সেই একই ঘটনা। লুণ্ঠন চলেছে; উদ্দেশ্য ছিল পাচারের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কায়েম করা। তাদের থামানো গেছে। কিন্তু মানুষের মুক্তি কি এসেছে? স্মৃতির কথকদের একজনও মুক্তি এসেছে বলে বলতে পারেননি। তাদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ও অতিদুঃসাহসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু তাদের মুক্তি আসেনি। বাস্তবতা এটাই।

আলবার্ট দ্রংয়ের আরও একটি বক্তব্য স্মরণীয়। তিনি বলছেন, মানুষের দেশপ্রেম ছিল নিখাদ। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষদের। তার ভাষায়, “আমরা যখন গ্রামে ঘুরেছি তারা আমাদেরকে নিজেদের খাবার থেকে ভাগ করে খাইয়েছে। না খেয়ে খাবার সংগ্রহ করেছে। যা আমরা ধনীলোক বা রাজনীতির সাথে জড়িতদের কাছ থেকে পাইনি।” আর এই দরিদ্র মানুষরাই যে কষ্ট পেয়েছে সবচেয়ে বেশি তাতেও তো কোনো সন্দেহ নেই। 

ওই কষ্টভোগের বিবরণ নানা স্থানে পাওয়া যাবে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে শঙ্করী দাসের বইয়ের দুই খণ্ড জুড়ে। যুদ্ধে গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে; সুবিধা যা হওয়ার হয়েছে ধনীদের ও রাজনীতি সংশ্লিষ্টদেরই। স্মরণীয় যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন ছিল জাতীয়তাবাদীদের হাতেই। যুদ্ধের পরও নেতৃত্ব তাদের হাতেই থেকেছে। তারা কেউ গরিব ছিলেন না। পরবর্তী সময় তারা আরও ধনী হয়েছেন। 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //