পাঁচ কালের পাঁচ ঈদের স্মৃতি

প্রথম ঈদের স্মৃতি
আমার প্রথম ঈদের স্মৃতি ৩-৪ বছর বয়সের। আমরা থাকতাম টিকাটুলী পাড়ায়, আমার জন্ম পাড়া। ৩ বছর পর্যন্ত বোধহয় আমাকে মসজিদের ঈদের নামাজে নেওয়া হয়নি। যা-ই হোক এর কিছুদিন পর ঈদ আসে আর আমি নতুন কাপড়-চোপড় পরে ঈদের নামাজে যাই বাবা ও বড় ভাইদের সঙ্গে। মধ্য পঞ্চাশ দশকের কথা।

সবার সাথে কী করলাম জানি না তবে ভাইরা-বাবা যা করলেন তা-ই করলাম। তারপর শুরু হলো খুতবার বয়ানে মৌলভী সায়েব যা বললেন তা হলো, মুসলমান ছাড়া কেউ স্বর্গে যাবে না। 

কথাগুলো শুনে আমার মনটা খুব দমে গেল। কারণ আমাদের পাড়ায় অনেক অমুসলমান থাকত, বাড়ির পাশেই ছিল একটা হিন্দুদের মেস। সবার সাথে সবার খাতির ছিল। আমি না বুঝতাম স্বর্গ, না বুঝতাম ধর্ম তবে আমরা মুসলমান আর তারা তা নয় মানে স্বর্গে যাবে না এটা বুঝলাম। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে ফিরেই মা যখন জড়িয়ে ধরে আদর করছেন তখন আমি বললাম, ‘মা, ওরা স্বর্গে যাবে না, ওরা মুসলমান না।’ 

দুই
আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরেই বললেন, ‘আল্লাহর কাছে শুধু দুই রকম মানুষ আছে, খারাপ মানুষ আর ভালো মানুষ। যারা ভালো মানুষ তারা স্বর্গে যাবে, যারা খারাপ তারা যাবে না। মসজিদে ভালো মানুষদের মুসলমান বলেছে ও আল্লাহর কাছে সব ভালো মানুষ মুসলমান।’ আমার মা আমাকে ওই ঈদের দিনে যে মুক্তি দিলেন তার চেয়ে বড় ঈদের উপহার আমি আর পাইনি ও আমার জন্য সব হিসাব সেই দিন হয়ে যায়। অতএব পৃথিবীতে কেবল ভালো আর খারাপ মানুষের বসবাস। বাকি সব পরিচয় গৌণ। ঈদ না হলে তো মার এই সব কথা শোনা হতো না যা আজও সাথে আছে ও জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদ। 

তিন
ঈদের আগের রাতে ও ঈদের দিন সমান মজার হয় বাচ্চা হলে। মনে আছে মনে হচ্ছিল এই দিনটার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো খাওয়া আর ভালো কাপড়-চোপড় পরে ঘুরে বেড়ানো। মা গল্প বলেছিলেন এমন দিনে ফেরেশতারা নাকি নিচে নেমে আসে মানুষের কাছে, অনেকে নাকি নামাজ পড়ে মসজিদে। তাই মসজিদে আমিও চারদিকে তাকাচ্ছিলাম, দুই একজনকে তো বেশ ফেরেশতা ফেরেশতা লাগছিল যদিও, ঠিক জানা নেই তারা কেমন দেখতে হয়। তবে সেই রাতে আমার কয়েক বছরের বড়, মেজো ভাই জানালেন আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে তারা দেখিয়ে, ওগুলো ফেরেশতা, রাতে আলো ফেলে যাতে মানুষ দেখতে পায় অন্ধকারে।

ঈদ ও আমার নতুন পাঞ্জাবির বায়না
আজকে এসে বেশ বিব্রতভাবেই বলছি যে ৬-৭ বছর বয়সের ঈদে এসে আমি একটা নতুন পাঞ্জাবির জন্য অনেক কেঁদেছিলাম এবং এটা নিয়ে আমি লজ্জিত। আমি বুঝতে পারি আমি একটা বেশ অসভ্য বাচ্চা ছিলাম এবং আমার বাবা-মার বহুত ধৈর্য ছিল। বিষয়টা এরকম ও সেই সময় বাড়িতে ঈদের কাপড় বানানো হতো- মা যে সব সেলাই করতেন তা নয়, অন্যরাও ছিল। তা ছাড়া ছিল বাড়ির দর্জি। সবার জন্য পাঞ্জাবি বানানো হয় কিন্তু আমারটা গায়ে একটু টাইট লাগছিল তাই আমার পছন্দ হয়নি। বলা যায় তখন থেকে আমি একটু মোটা হওয়া শুরু করেছি। দিনটা মন খারাপ করেই পার হলো। কিন্তু রাতের দিকে যখন বাবা বাড়ি ফিরলেন কাজ থেকে আর সবার কাপড়-চোপড় দেখতে চাইলেন, আমি নিজেরটা পড়লাম। কিন্তু প্রায় কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে। ৮-৯টার দিকে সেটা ফুঁপিয়ে কান্নায় পরিণত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা বেশ জোরে চিৎকার করে কান্নায় প্রমোশন পেল।

দুই
শেষে কী আর করা, বাবা গাড়ি বার করলেন এবং আমরা সবাই রওনা হলাম পুরান ঢাকার দিকে। তখন নতুন ঢাকা তেমন হয়নি, দোকানপাট অনেক আগেই ঘুমাতে যেত। আমাদের গাড়িটা ছিল উইলিস জিপ। নাম্বারটা এখনো মনে আছে, কইগ ৪৬২। রাতের রাস্তা কোনো ট্রাফিক নেই, আমরা বেশ জলদি পৌঁছে গেলাম চকবাজার, সব কিছুর আড্ডাখানায়। আমার বাবা ন্যাশনাল ব্যাংক/সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন, সদরঘাট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার তাই পুরান ঢাকা তার চেনা। আমি ওই প্রথম দেখলাম চাঁদ রাতের জাগ্রত ঢাকা, পুরান ঢাকায় কত মানুষ এসেছে কেনাকাটা করতে। আমরা এক কাপড়ের দোকানে গেলাম, একটা সাদা বাচ্চাদের পাঞ্জাবি গায়ে পরানো হলো, আমার পছন্দ, সবার পছন্দ, খেলা শেষ। বাবা মাকে একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। সাথে ছিল আমার মেজো মামা-নজুমামা আর আমার দুই বড় ভাই। আমার মনে আছে এক বিরাট কাপড়ের স্তূপ, লোকে তুলছে, দেখছে, দিচ্ছে, নিচ্ছে, কিনছে। উল্টো দিকে ছিল একটা সোনার দোকান। বাবার পরিচিত এক ব্যক্তি এসেছেন, তার স্ত্রীকে ঈদের গহনা কিনে দিলেন। বেশ মজা লেগেছিল বিষয়টা, এখনো মনে আছে। তখনি বুঝেছিলাম সবার ঈদ এ রকম হয় না। তারপর আবার বাড়ি ফেরা অন্ধকার ঢাকার রাস্তা দিয়ে। 

তিন
বাড়ি ফিরে দেখলাম আমাদের মামাদের/নানাবাড়িতে রান্না চলছে। আমার নানা ইন্ডিয়ায় থাকতেন, নিয়মিত আসতেন- থাকতেন, ঈদের সময় তো আসতেনই। উনার ব্যবসা ছিল শিলং শহরে। খুব রান্না করতে পছন্দ করতেন। মনে আছে বড় কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ল্যাম্পের ভেতরে রেখে নানা আর নানি রান্না করছেন। তাদের আমার কাপড়-চোপড় দেখানো হলো। বাবা চা খেতে বসলেন, মা গেলেন রান্না দেখতে আর আমি এর পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। 

যুদ্ধের আগের ঈদ
যেদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একটি অফিসে পাবলিক আগুন দেয় সেটা আমার জন্মদিন ছিল বলে মনে আছে। আমরা ছাদ থেকে বসে দেখছিলাম সন্ধ্যার আকাশ কত লাল হতে পারে। আগুন দেখা যায়নি, তার আলো দেখা গিয়েছিল; কিন্তু আজ বুঝি কত প্রতীকী ছিল সেটা। ওই আগুনের নিচে যে পাকিস্তানের যা কিছু বাকি ছিল বাংলাদেশে সেটা যে পুড়ে ছারখার হচ্ছে এটা অনেকেরই মনে হচ্ছিল। আগুন দেওয়ার পর বেশি দিন টেকেনি আইয়ুব খান। তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় এলো ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশের মানুষের কাছে, এক আর্মি থেকে আর এক আর্মি, কিন্তু একটা বড় তফাত ছিল। একবার যখন মহা প্রতাপশালী এক নম্বর খান গেছে, তখন ২ নম্বর খান আর কয়দিন?

সেই কারণে মনে হয় এই ঈদ ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঈদ যদিও সেটা রাজনৈতিক ও মানে একটা দেশে যেটা প্রায় অলীক সেটা আগুনের আলোতে মিলিয়ে যাচ্ছে আর অন্যদিকে-“রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।” 

দুই
তখন আমরা স্কুল শেষ করছি, কী পরেছি, কী খেয়েছি অত স্মরণ নেই। কারণ হয়তো ওই সব বিষয় আর এত বড় কিছু ছিল না। তবে মনে আছে সবাই জানতে চেয়েছিল শেখ মুজিব কোথায় নামাজ পড়েছিল? মৌলানা ভাসানী কই ছিল এটা নয়। কারণ তিনি তো মৌলানা, তিনি তো ইমামতি করবেন ও মধ্যবিত্ত মুসলমান বাঙালির মানসিক রূপটা এটা থেকে বোঝা যায়। তবে সেই ঈদ ছিল আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে উৎফুল্ল, আনন্দের, আশার ঈদ ও আইয়ুব গেছে, নির্বাচন আসছে, বিজয় আসছে। কিন্তু যুদ্ধ যে আসছে এটা কেউ ভাবেনি তাই কোনো শঙ্কা ছিল না মনে। জানা না থাকাতেই এত ভালো লেগেছিল ওই ঈদ।

তিন
আমাদের বাড়িতে আড্ডার কথাটা মনে আছে যেখানে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিল, অনেকে যারা অনেক দিন আসেনি। ওই ঈদের দিন যেন ছিল এক মুক্তির ঈদ। আমার বাবা ব্যাংকে কাজ করতেন, গোটা পাকিস্তানে দ্বিতীয় প্রধান। ভোট হলে যে আওয়ামী লীগ মানে পূর্ব পাকিস্তানিরা সরকার গঠন করবে এটা ছিল নিশ্চিত আর তার মানে বাবা যে ব্যাংকের প্রধান হবে সেটাও নিশ্চিত। তাই সেদিন অফিসের অনেক মানুষ আসে, বাবার সহকর্মীরা। ঈদের উদযাপন ছিল দেশের মানুষের সবার, মধ্যবিত্তের বিশেষ করে। সেই কারণে আর একটু বেশি খুশি ছিল সবাই।

চার
সেদিন সন্ধ্যায় বাবার সাথে দেখা করতে আসে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের এক সদস্য। এই ২২ পরিবারে হাতেই ছিল পাকিস্তান দেশের সব টাকা। এরা ছিল অবাঙালি কিন্তু ১৯৪৮-এর পর থেকে ঢাকায়। বাড়ির জন্য ফুল আর মিষ্টি আনেন। বাবার সাথে অনেক কথা বলেন। তার বন্ধু স্থানীয় ছিলেন। তারা চিন্তিত ছিলেন কিছুটা পরিস্থিতি নিয়ে। বাবা তাদের বলেন সব ঠিক হয়ে যাবে তবে বাঙালিদের আরও সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। আরও কিছু আলাপ করে তারা চলে যান। মানুষের ঈদের আনন্দ উৎসবের বাইরে কত বড় ইতিহাসের উদযাপনের পটভূমি তৈরি হচ্ছে কেউ জানত না।

যুদ্ধের বছরে ঈদ
ওই বছরের ঈদ উদযাপনের কোনো স্মৃতি নেই। কারণ সেটা করা হয়নি। যারা মসজিদে গিয়েছিল তারা যায় বিষণ্ণ মনে, কেউ কেউও ভয়ে যেন মসজিদগামী হলে পাকিস্তানিদের হাতে বিপদের শঙ্কা কম। খুব কম বাড়িতেই এটা উৎসব ছিল। রাতে সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে, অনেকের জন্য ওটাই সবচেয়ে আনন্দের সময় ছিল সারা দিনে। যুদ্ধ চলছে, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। 

প্রবাসে ঈদ
২০০৭ সালে আমি কানাডা প্রবাসী হই পরিবারসহ। আমরা গিয়ে উঠি যে এলাকাটাতে তার নাম ডস এন্ড ডানফোর্থ ও সবার কাছে বাংলা পাড়া। গোটা কানাডার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি থাকে সেখানে, সবাই অভিবাসী, বেশ অসচ্ছল ও অনেকেই কিছুদিন থাকার পর একটু সুবিধা হলে অন্যত্র চলে যায়, যাকে বলে মধ্যবিত্ত এলাকায় তবে অনেকেই থেকে যায়। বাঙালি পাড়া আমার ভালো লাগত। নিজের মতো থাকা যায় একটু সাবধানে থাকলে, লোকাল পলিটিক্সের সাথে না জড়ালে। ওটা প্রচুর আছে টরন্টোতে। সব জায়গাতেই আছে, কী আর করা।

দুই
আমি কাজ করতাম এক এনজিওতে। বাংলাদেশ-কানাডিয়ান কমিউনিটি সার্ভিস। সংক্ষেপে বিসিএস। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন মুশতাক সাহেব। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে খুব শ্রদ্ধার পাত্র, সিলেটের মানুষ, মিডলইস্টে ছিলেন, শেষে কানাডায় ও খুবই ধার্মিক মানুষ এবং সৎ নির্ভরযোগ্য হিসেবে সম্মানিত। তিনি ও তার সহযোগীরা চেষ্টা করছিলেন একটা মাঠে-ডেন্টোনিয়া পার্ক বোধহয়-উন্মুক্তভাবে ঈদের জামাত আয়োজন করতে। ওখানে থাকতে থাকতেই ঘটনাটা ঘটে এবং সবার জন্য ছিল আনন্দের। এটা ছিল স্বীকৃতি বাংলাদেশি মুসলমান জনগোষ্ঠীর, কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। যেহেতু নিজেদের মধ্যে মসজিদকে কেন্দ্র করে ঝামেলা হয়, তাই অনেকের জন্য ছিল বেশ স্বস্তিকর বিষয় এই সবার জন্য ঈদের নামাজ একসাথে। 

তিন
আমার ছেলে আর আমি পাঞ্জাবি ও প্যান্ট পরে নামাজে গেলাম। বহু মানুষের সমাগম। সবার মনে আনন্দ। একসাথে আমরা সবাই নামাজ পড়ছি, আসলে জানান দিচ্ছি, আমরা আছি, আমরা বাংলাদেশি, আমরা আছি। এই ঈদে কেমনভাবে উদযাপন করেছিলাম মনে নেই, মনে আছে আমরা কয়েকশ বাংলাদেশি মানুষ, এক হতে পেরেছি, উন্মুক্ত মাঠে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //