সুলতানা রাজিয়া: এক দাসকন্যার উত্থান

আমি যদি জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হই, তবে জনগণ আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করুক: সুলতানা রাজিয়া (১২০৫-১২৪০)

এক

মামলুক বংশীয় এক মুসলিম নারী পুরো ভারতবর্ষকে এক সময়ে দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন। আর এই নারী এক দাসকন্যা, যিনি রাজিয়া সুলতানা নামেই পৃথিবীতে খ্যাত। আমরা জানি যে, মামলুকরা ছিলেন দাস। তবে তারা ছিলেন যোদ্ধাজাতি। ইসলাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে সর্বশ্রেণির মানুষ এর সাম্যের আদর্শে উজ্জীবিত হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।

রাজিয়ার জন্ম আনুমানিক ১২০৫ সালে; বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশে। তিনি ছিলেন পঞ্চম মামলুক অধিপতি এবং দিল্লির সালতানাতের ইতিহাসে একমাত্র নারী সুলতান অর্থাৎ সুলতানা। তিনি ছিলেন দিল্লির সালতানাতের তৃতীয় সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের কন্যা এবং প্রথম মামলুক সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের নাতনি। কুতুব উদ্দিন আইবেকের অধীনস্থ ছিলেন ইলতুতমিশ। তিনি তাকে গড়েপিঠে তোলেন এবং তার কন্যা তুর্কান খাতুনের সঙ্গে বিয়ে দেন। তারই কন্যা রাজিয়া।

ইলতুতমিশের পরে প্রথমে তার পুত্র নাসিরুদ্দিন মাহমুদই সুলতান হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১২২৯ সালে মাত্র দেড় বছর রাজত্ব করার পর তিব্বত অভিযান শেষে প্রচন্ড শীতে অসুস্থ হয়ে মারা যান। ইলতুতমিশের আরও এক কন্যা ছিলেন, যার নাম ছিল সাজিয়া বেগম। কিন্তু বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরে তিনি সিংহাসনে বসেননি। ফলে তারপরেই ক্ষমতায় আসেন রাজিয়া। কালচারাল ইন্ডিয়া (culturalindia.net) বলছে, রাজিয়ার মায়ের নাম কুতুব বেগম। কিন্তু এর সপক্ষে তারা কোনো দলিল উপস্থাপন করেনি।

রাজিয়ার পুরো নাম রাদিয়াতুদ-দুনিয়া ভা দ্বীন। তবে তিনি নিজের নাম ঘোষণা করেছেন সুলতান জালাল-আদ-দুনিয়া ভা দ্বীন এবং আস-সুলতান আল-মুয়াজ্জাম রাদিয়াতুদ-দ্বীন বিনতে আস-সুলতান। স্মর্তব্য যে, আরবি রাদিয়া নামটি ফারসিতে উচ্চারিত হয় রাজিয়া। আর সেই সঙ্গে বলা চলে, ভারতে মুসলমান নারীর ক্ষমতায়নের এবং রাজ্য চালানোর পারঙ্গমতার চিত্রটি মোটেই নতুন নয়, অন্তত যদি আমরা রাজিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকাই।

দুই

রাজিয়ার ইতিহাস জানতে হলে প্রথমে কিছুটা মামলুকদের ইতিহাস জানা জরুরি। ‘মামলুক’ আরবি শব্দ, যার অর্থ অন্যের অধীকৃত। মামলুকের বহুবচন মামালিক। তারা যে দাস সম্ভূত, তা তাদের গোষ্ঠীর নামের মধ্যেই আছে। বোঝা যায়, মুসলমান খেলাফত ও রাজবংশগুলোর কাছে পরাজিত দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের রাজ-রাজড়াদের বন্দি সেনারাই ইসলাম গ্রহণ করে মামলুক নামে অভিহিত হয়েছেন। তাই মামলুকরা আদতে বহু জাতির মিশ্রণ।

দক্ষিণ রুশদেশ, পশ্চিম, মধ্য ও উত্তর এশিয়ার তুর্কি জাতিগোষ্ঠী, ককেশাস জাতির কিছু  অংশ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের জাতিগোষ্ঠী নানা সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আরব জাতির বিভিন্ন গোত্রের ও রাজবংশের এবং ওসমানীয় শাসকদের সেনাবাহিনীতে উচ্চ পর্যায়ে ও সাধারণ সেনা হিসেবে ব্যাপক সংখ্যায় কাজ করেন। এরা জাতিগতভাবে আর্য, সিরকাসীয়, মঙ্গোলীয় ও স্লাাভিকদের সংমিশ্রণ।

ইসলাম গ্রহণের পর তারা বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং মুসলমান রাজত্বগুলোর সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখেন। এদেরই একজন ছিলেন কুতুব উদ্দিন আইবেক। দিল্লির কুতুব মিনার তারই স্মরণে তৈরি এবং এখানেই রয়েছে তার সমাধি প্রাঙ্গণ। শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের সমাধিও এখানেই।

কুতুব উদ্দিন আইবেক ছিলেন ঘোরী রাজবংশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী সেনাপতি। তিনি কাজ করতেন ঘোরী বংশের রাজা মোহাম্মদ ঘোরীর অধীনে। মোহাম্মদ ঘোরীর পুরো নাম মুইজ উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে শাম ঘোরী। আফগানিস্তান তাদের প্রধান শাসনকৃত অঞ্চল এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল ফারসি। তাই ফারসি প্রভাবিত সমাজভুক্ত ছিলেন তারা। তবে তারা ছিলেন সুন্নী মুসলমান। মামলুকরাও তাদের সংস্পর্শে ফারসি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এখনে স্মর্তব্য যে, পারসিক সম্রাট বা রাজ-রাজড়াদের সরাসরি কখনো দিল্লি বা ভারত শাসনের ইতিহাস নেই।

মোহাম্মদ ঘোরীর মৃত্যু হয় আকস্মিকভাবে লাহোরে। স্থানীয় গণ্যমান্য সামন্তরা আরাম শাহকে দিল্লির মসনদে বসান। কিন্তু সালতানাতে আরও সামন্ত ও গণ্যমান্য ছিলেন, যারা তার বিরোধিতা করেন। তাদের কাছে ইলতুতমিশ ছিলেন অধিক যোগ্য, আর প্রভাবশালী সেনাপতি কুতুব উদ্দিন আইবেক তাকে পুত্র বলে সম্বোধন করতেন। ফলে তার ক্ষমতারোহণের পেছনে কোনো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিল না।

তিন

নাসিরুদ্দিন মাহমুদের পর তার আর কোনো পুত্রকে সিংহাসনে বসার উপযোগী মনে করতেন না ইলতুতমিশ। পারসিক ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ জুযজানি লিখেছেন, ইলতুতমিশ ভোগবিলাসে মত্ত এই পুত্রদেরকে অপদার্থ জ্ঞান করতেন। ১২৩১ সালে গোয়ালিয়র অভিযানে যাওয়ার আগে তিনি রাজিয়াকে দিল্লির প্রধান প্রশাসক হিসেবে মনোনীত করেন। রাজিয়া তার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। এরপরই তিনি রাজিয়াকে তার উত্তরসূরি করবেন বলে স্থির সিদ্ধান্তে আসেন।

তিনি তার অধীনস্থ মুশরিফ-ই-মামলাকাত তাজুল মুল্ক মাহমুদকে এই মর্মে ফরমান জারি করতেও বলেন। সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্যরা এক্ষেত্রে তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তার কিছু পুত্র সন্তানও আছেন। তিনি তাদের সাফ জানিয়ে দেন, রাজিয়া তাদের চেয়ে রাজ্য পরিচালনা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে অধিক সক্ষম। (Nizami: 1992: 231)

ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর সম্ভ্রান্তরা তার পুত্র রুকনুদ্দিন ফিরুজকে নতুন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। ইলতুতমিশ তাতে রাজি হলেও মৃত্যুর আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ছেলেকে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনেন। (Nizami: 1992: 231) অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রাজিয়া ক্ষমতায় আরোহণের পর তার গুণগ্রাহীরা তাকেই ইলতুতমিশ উত্তরসূরি হিসেব ঘোষণা করেছিলেন বলে চাউর করেছে। মিনহাজের সূত্রে হিস্টোরিয়া ইসলামিকা লিখেছে, In spite of the fact that Iltutmish appointed his daughter to take control of the Delhi sultanate when he passed away, the nobility unanimously appointed another son of the sultan after his death, Rukn al-Din Firuz. There are some historical discussions and even legendary aspects around this story. One of the reasons why some believe that Firuz’s appointment took place is because when the sultan was alreadz ill, he had his son from Lahore to return to Delhi. Also, the story of the appointment of Razia as a sultana by her father could very well have been an invention on the part of her supporters even after she ascended to power. [Razia Sultana: India’s most amazing Muslim Queen. História Islâmica (historiaislamica.com)]

তবে এই ইতিহাস প্রথম লিপিবদ্ধ করেন মিনহাজ-ই-সিরাজ জুযজানি, কিন্তু তিনি ওই ঘটনার সমসাময়িক কালের হলেও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। (Jackson: 2003: 46) কোনো কোনো সূত্র বলছে, রুকনুদ্দিন প্রথমে শাসনকার্য চালাতে ব্যর্থ হলে তিনি তার মা শাহ তুর্কানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ঐতিহাসিকরা শাহ তুর্কানকে ইলতুতমিশের স্ত্রী না বলে সঙ্গিনী (consort), এমনকি রক্ষিতা (concubine) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মানে রুকনুদ্দিন ও রাজিয়ার মা ভিন্ন ভিন্ন। তবে মা ও পুত্র একটি কুকর্ম করেন। তারা ইলতুতমিশের জনপ্রিয় পুত্র কুতুবুদ্দিনকে হত্যা করেন। ফলে রাজ্যে প্রবল বিদ্রোহের সূচনা হয়। আর এই বিদ্রোহে বেশ কিছু  সম্ভ্রান্ত এমনকি রাজ্যের প্রধান উজির নিজাম-উল-মুল্ক পর্যন্ত শামিল হন।

Despite the appointment of Rukn al-Din Firuz to be the new rightful sultan, his mother, Shah Turkan, actually ruled the Delhi sultanate. In fact, Shah Turkan was unpopular with the subjects. Due to the death of another son of Iltutmish, Qutubuddin, much loved by the people, as well as ruling with an iron fist, several rebellions occurred against the government of Shah Turkan, many of them led by the nobility itself and even of the Prime Minister of Delhi, Nizamul Mulk Junaidi, who allied with the rebels. (Ibid)

আর অন্যদিকে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পেছনে আরকেটি নেতিবাচক কারণ ছিল, তা হচ্ছে উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদ। রুকনুদ্দিন সেই সব সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যা করছিলেন, যারা মূলত তাজিক ছিলেন, তুর্কি ছিলেন না। এই জাতিবিদ্বেষের বলি হন প্রধান উজিরের পুত্র জিয়া-উল-মুল্ক।

Regardless of the chaotic situation that had set in, things were going to get worse when officers of Turkish and slave origins close to Rukn al-Din would plan the death of other government officials who were not Turkish (Tazik). This caused the death of several important officials of the sultanate, including the Prime Minister Junaidi’s son, Ziyaul Mulk. Even Tajul Mahmud, who had written the decree naming Razia as Iltutmish’s sucessor had been killed. (Ibid)

অন্যদিকে রাজিয়ার জনপ্রিয়তা জনমানসে আগেই ছিল, ক্রমশ তা আরও বাড়তে থাকে। রাজিয়ার মধ্যে অন্ধ জাতীয়তাবাদ বা গোত্রবাদ ছিল না। যে কারণে শাহ তুর্কান রাজিয়াকে হত্যারও পরিকল্পনা করেন। জানা যায়, রাজিয়া লাল পোশাক পরে নিজেকে রক্ষা করেন। সেকালে সাদা পোশাক পরত সাধারণ জনগণ। কোনো ব্যক্তি বিপদাপন্ন হলে বা কোনো অন্যায়ের সম্মুখীন হলে সে রঙিন পোশাক পরত এবং একটি নির্দিষ্ট ঘণ্টা বাজাত। রাজিয়াও তাই করেন। তিনি জনতার কাছে তার বিপদের কথা তুলে ধরেন এবং তাদের জানান কীভাবে তার সৎভাই রুকনুদ্দিন তার আরেক সৎভাই কুতুবুদ্দিনকে হত্যা করেছে।

চার

ক্ষমতারোহণের জন্য রাজিয়া এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি ছিলেন সুবক্তা ও অত্যন্ত কৌশলী। তিনি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিপরীতে তুলে ধরেন। শুক্রবারের জুমার নামাজের সমাবেশগুলোতে তার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা তিনি জনসম্মুখে প্রকটিত করেন। তিনি জনতার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। জনতা তার পক্ষাবলম্বন করেন, সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেও। এর পেছনে প্রধান উজিরের সাহায্য হয়তো বিষয়টিকে আরও বেগবান করেছে।

যা হোক ক্ষিপ্ত জনতা একসময় প্রাসাদ আক্রমণ করে বসে। তারা শাহ তুর্কানকে গ্রেপ্তার করে। সম্ভ্রান্তদের বড় অংশও রাজিয়ার পক্ষাবলম্বন করেন। রুকনুদ্দিন অবশ্য এতেও দমেননি। তিনি তার দলবল নিয়ে রাজিয়ার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। রাজিয়া সৈন্য প্রেরণ করলে তারা পরাজিত হন এবং রুকনুদ্দিনকে কারারুদ্ধ করা হয়। সাত মাস ছিল তার রাজত্ব। সম্ভবত ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। (উপরোক্ত) মানব ইতিহাসে শুধু বাগ্মিতা দিয়ে কোনো নারীর এরকম গণ-আন্দোলন তৈরির ইতিহাস নজিরবিহীন।

রাজিয়া শুধু ভারতের প্রথম সুলতানা ছিলেন না, শাসক হিসেবেও তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, ‘আমি যদি জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হই, তবে জনগণ আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করুক।’ (Nizami: 1992: 237)

পাঁচ

রাজিয়ার ক্ষমতারোহণের চার বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর বেশ কিছু  কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তারা তার সৎভাই মুইজুদ্দিন বাহরাম ওরফে বাহরাম শাহকে ক্ষমতায় বসান। রাজিয়ার এই পতনের নানা ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকরা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মার্নিসি লিখেছেন, রাজিয়া ইয়াকুত নামের এক ইথিওপিয়ান অর্থাৎ আবিসিনীয় ক্রীতদাসের প্রেমে পড়েন এবং তিনি তাকে দ্রুত উঁচু এক সরকারি পদে (আমির-ই-আখুর) উত্তীর্ণ করেন। এতে সামরিক বাহিনীর বড় এক অংশ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। (Mernissi: 1997)

তবে এই ইতিহাস কিছুটা জটিল ও ধোঁয়াটে। একটি সত্য এখান থেকে বের হয়ে আসে যে, ইথিওপিয়ান অর্থাৎ হাবশী ক্রীতদাসের প্রেমে যদি রাজিয়া সত্যি পড়ে থাকেন, তবে তা আবারও প্রমাণ করে যে, তিনি মোটেই বর্ণবাদী ছিলেন না। অন্যদিকে রাজিয়া তখন বিবাহিতও ছিলেন না। আর রাজিয়া পর্দাপ্রথা মেনে চলতেন। জনসম্মুখে এলে তিনি ‘কাবা’ নামক আলখাল্লা ও ‘কুলাহ’ নামক লম্বা টুপি পরিধান করতেন এবং সর্বদা নারী সেনা দ্বারা পরিবৃতা থাকতেন। শহর ভ্রমণে কিংবা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গমন করতে তিনি হাতির পিঠে যাতায়াত করতেন। Nizami: 1992: 240)

তবে জীবনের প্রথম লগ্নে তিনি যাবতীয় যুদ্ধবিদ্যার কৌশল রপ্ত করেছিলেন। শালীন পোশাকে তিনি ঘোড়ায় বা হাতির পিঠে চড়ে যাতায়াত করতেন। কোনো কোনো মতে, সেই পোশাক ক্ষাণিকটা পুরুষালি ছিল। [Razia Sultana Biography - Childhood, Life Achievements & Timeline (thefamouspeople.com)] যা হোক, ক্রীতদাস জামালুদ্দিন ইয়াকুত যদি তার যোগ্যতার বলে উচ্চপদে আরোহণ করেন, তবে রাজিয়া তাতে বাদ সাধবেন কেন? অবশ্য কোনো কোনো সূত্র বলছে, তুর্কি জাতীয়তাবাদী সম্ভ্রান্তরা এই গুজব ছড়িয়েছিল।

বোঝাই যাচ্ছে যে, তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের একটি মোক্ষম সুযোগ খুঁজছিলেন। আর ইতিহাস থেকে জানা যায়, তুর্কি জাতীয়তাবাদী সম্ভ্রান্তরা শুরু থেকেই রাজিয়ার প্রবল বিরোধিতা করে আসছিলেন। কিন্তু রাজিয়ার উত্থানের পেছনে ছিল সাধারণ জনতা। তিনি তুর্কি জাতীয়তাবাদী সম্ভ্রান্তদের বিপরীতে অতুর্কিদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। (Nizami: 1992: 238)

ইসলামি সাম্যের প্রেরণা রাজিয়ার মধ্যে অনেকটাই ছিল বলা চলে। তিনি ইলতুতমিশ কর্তৃক ক্রয়কৃত ইখতিয়ারুদ্দিন আতিগিন নামক এক তুর্কি ক্রীতদাসকে আমির-ই-হাজিব পদে উন্নীত করেন এবং ইখতিয়ারুদ্দিন আলতুনিয়া নামের অপর এক তুর্কি ক্রীতদাসকে প্রথমে বারানের, পরে তাবারহিন্দের ইকতা বা রাজস্ব গ্রহণকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। (Nizami: 1992: 241)

অনেকে বলবেন রুকনুদ্দিনও তো অনেক ক্রীতদাসকে উচ্চপদে সমাসীন করেছেন। সমস্যা হচ্ছে রুকনুদ্দিন শুধু তুর্কি দাসদের প্রতি সেই বদান্যতা দেখিয়েছেন এবং তাদের তিনি তাজিক ও অতুর্কি কর্মকর্তাদের নিধনে ব্যবহার করেছেন। (Nizami: 1992: 235-236) প্রধান উজির নিজাম-উল-মুল্ক মুহাম্মদ জুনায়েদী ছিলেন তাজিক, যাকে ইলতুতমিশ ওই পদে অধিষ্ঠিত করেন।

তার মানে ইলতুতমিশ নিজেও তার কন্যা রাজিয়ার মতোই গোত্রবাদী বা জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। যে কারণে এক অতুর্কিকে তিনি প্রধান উজির করেছিলেন। কিন্তু নিজাম-উল-মুল্ক রাজিয়ার বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহের কালে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। অবশ্য তার একটি কারণ ছিল এই যে, ক্ষমতায় আসার পরপরই রাজিয়া কিছু  গুরুত্বপূর্ণ পদে রদ-বদল করেন।

তিনি খাজা মুহাজ্জাবুদ্দিনকে প্রধান উজির হিসেবে নিয়োগ দেন এবং তাকে নিজাম-উল-মুল্ক উপাধি প্রদান করেন, যিনি আগে ছিলেন জুনায়েদীর পরবর্তী জন। এতে জুনায়েদী বিদ্রোহের মদদদাতা প্রধান চার তুর্কি সম্ভ্রান্তের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। তবে বিষয়টি এমনও হতে পারে যে, কুচক্রীদের সঙ্গে মুহাম্মদ জুনায়েদীর আগে থেকেই আঁতাত ছিল জেনেই রাজিয়া তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন।

এই কুচক্রী চার সম্ভ্রান্ত ছিলেন যথাক্রমে-বাদুয়ানের মালিক ইজ্জুদ্দিন মুহাম্মদ সালারি, মুলতানের মালিক ইজ্জুদ্দিন কবির খান আয়াজ, হানসির মালিক সাইফুদ্দিন কুচি এবং লাহোরের মালিক আলাউদ্দিন জানি।

রাজিয়া মানবিক গুণসম্পন্না ছিলেন। তাই তিনি ঢালাওভাবে তুর্কিদের বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি ছিলেন উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদের বিরোধী। প্রধান সেনাপতি হিসেবে কিন্তু তিনি এক তুর্কিকেই মনোনয়ন দিয়েছিলেন; আর তিনি হলেন মালিক সাইফুদ্দিন আইবেক বাহতু। অবশ্য তার মৃত্যুর পরে পূর্ব ইরানী তাজিক বংশোদ্ভূত ঘোরী বংশের মালিক কুতুবুদ্দিন হাসান ঘোরীকে তিনি প্রধান সেনাপতির মনোনয়ন দেন, যার উপাধি হয় নায়েব-ই-লশ্কর।

যা হোক কুচক্রী চার সম্ভ্রান্তের বাহিনীগুলো নানান দিক থেকে আক্রমণ করলে রাজিয়া তার নিযুক্ত অযোধ্যার সুবাহদার মালিক নাসিরুদ্দিন তাইসির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু গঙ্গা পার হয়ে দিল্লি যাওয়ার পথে তাইসি কুচির বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং বন্দি অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়।

ছয়

রাজিয়ার চার বছরের কম শাসনামলে (১২৩৬-১২৪০) তাকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং তাকে অনেক দ্রুত বেশ কিছু  কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাতে তিনি অসাধারণ দক্ষতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। যেমন লাহোরের ইকতা বা রাজস্ব গ্রহণকারী পরিবার ছিল কুচক্রী আলাউদ্দিন জানি। তাকে হত্যা করে আরেক কুচক্রী ইজ্জুদ্দিন কবির খান আয়াজকে রাজিয়া সেই দায়িত্ব দেন।

এর ফলে এই বিদ্রোহী তার পক্ষাবলম্বন করেন। পূর্ব দেবালের লাখনাওতির সব সম্ভ্রান্তই তার বশ্যতা স্বীকার করেন। তবে রাথামবোরের উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদী সম্ভ্রান্তদের তিনি জায়গাছাড়া করতে পারলেও সেখানকার হিন্দুরাজা চাহামানা, যিনি নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন, তাকে রাজিয়া পরাস্ত করতে ব্যর্থ হন। রাজস্থানের এই রাজা মেওয়াতীদের সঙ্গে মিলে দিল্লির চারপাশে গেরিলা অভিযান গড়ে তোলেন। তবে রাজিয়াকে তারা দুর্বল করতে পারেননি। রাজিয়া ইসমাইলী শিয়া বিদ্রোহীদের কার্যকরভাবে দমন করেন।

ইসমাইলী শিয়াদের অন্তর্গত কারমাতীয়রা একবার দিল্লি জামে মসজিদ আক্রমণ করেন। কারমাতীয় নেতা নুরুদ্দিন তুর্ক সুন্নী হানাফী ও শাফী মতবাদ সম্পর্কে বিষোদ্গার করেন। তিনি দিল্লি, গুজরাট, সিন্ধ ও দোয়াব থেকে প্রায় এক হাজার অনুসারী একত্রিত করেন। ১২৩৭ সালের ৫ মার্চ তারা জুমার নামাজের সময় মসজিদের ভেতরে অতর্কিতে প্রবেশ করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন। রাজিয়া এই বিদ্রোহ কার্যকরভাবে দমন করেন। ১২৩৮ সালে রাজিয়া মঙ্গল আক্রমণও ভালোমাতো সামাল দেন। (Nizami: 1992: 243)

তার এই স্বল্প শাসনামলে তিনি চমৎকার এক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন, প্রশাসনে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন এবং বাণিজ্যে লোকজনকে আগ্রহী করতে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেন।

[In her almost four years of rule she established proper law and order, made governmental reforms, infrastructural improvements and encouraged trade. (Razia Sultana–Life History, Facts, Achievements & Death (culturalindia.net)]

সাত

কুচক্রী ইজ্জুদ্দিন কবির খান আয়াজ একবার রাজিয়ার বশ্যতা স্বীকার করলেও তিনি আবারও রাজিয়ার বিরুদ্ধে চলে যান এবং ১২৩৮-১২৩৯ পর্যন্ত তিনি রাজিয়াবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু রাজিয়ার বাহিনী হামলা করলে তিনি লাহোর ছেড়ে তৎকালে মঙ্গল অধ্যুষিত সোধরাতে পলায়ন করেন। শেষে রাজিয়ার বাহিনীর কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করলে রাজিয়া তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেন।

তিনি লাহোরের ইকতার পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে মুলতানের ইকতা হিসেবে নিয়োগ দেন। রাজিয়ার এইসব বদান্যতা হয়তো মানবিক দিক দিয়ে ঠিক হলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে হয়তো ভুল ছিল। ইখতিয়ারুদ্দিন আতিগিন ও ইখতিয়ারুদ্দিন আলতুনিয়া নামক যে তুর্কি ক্রীতদাস দুজনকে তিনি উচ্চপদে উন্নীত করেন, তারাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ান। তারা তুর্কি বিদ্রোহে স্বগোত্রের গোত্রবাদীদের পক্ষ নেন।

নানা সফরে রাজিয়াকে বের হতে হতো রাজ্যের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনে। রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধলে তার এই তৎপরতা আরও বাড়ে। ১২৪০ সালের ৩ এপ্রিল রাজিয়া দিল্লিতে ফিরলে তিনি দেখেন যে, ইখতিয়ারুদ্দিন আলতুনিয়া তাবারহিন্দাতে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। অথচ আলতুনিয়াকে তিনিই ক্রীতদাস থেকে প্রথমে বারান ও পরে তাবারহিন্দার ইকতা বানিয়েছিলেন। তিনি তার বিশ্বস্ত ইয়াকুতকে নিয়ে তাবারহিন্দার দিকে যাত্রা করেন। এই অভিযানে ইয়াকুত মারা পড়েন, আর সুলতানা রাজিয়া হন বন্দি।

আট

রাজিয়ার পতনের পর ১২৪০ সালের ২১ এপ্রিল রাজিয়ার সৎভাই মুইজুদ্দিন বাহরাম আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। দিল্লি আবারও তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের খপ্পরে পড়ে। ইসলামের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল রাজিয়া ছিলেন সব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। কারণ জাতীয়তাবাদ অখণ্ড মানবতাকে হত্যা করে। যা হোক, এবার তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা সালতানাতের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন।

রাজিয়া এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ও নিজেকে মুক্ত করতে, সেই সঙ্গে হৃত রাজ্য উদ্ধার করতে ১২৪০ সালের সেপ্টেম্বরে আলতুনিয়াকে বিয়ে করেন। কোনো কোনো সূত্র অবশ্য বলে, রাজিয়া ও আলতুনিয়ার মধ্যে প্রেম তাদের শৈশব থেকেই ছিল। তুর্কি সম্ভ্রান্তরা তার ও রাজিয়ার মধ্যে বিষাদ ছড়াতেও ইয়াকুতের সঙ্গে রাজিয়ার প্রেমের কিচ্ছা তৈরি করেছিলেন। অন্যদিকে পরে আলতুনিয়ারও আর কোনো উপায় ছিল না। রাজিয়ার পতনের পর তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা এই ক্রীতদাস ইকতাকে আর পাত্তাও দিচ্ছিল না।

নিজামি ঐতিহাসিক আব্দুল মালিক ইসামির বরাতে লিখেছেন, এবার আলতুনিয়া এক সামরিক বহর নিয়ে দিল্লির দিকে যাত্রা করেন। মুইজুদ্দিন বাহরাম তার বিপরীতে নিজের সেনাবহিনী প্রেরণ করেন। রাজিয়া ও আলতুনিয়ার বাহিনী কাইথালে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে তাদের সৈন্যবাহিনী তাদের ত্যাগ করে। একদল হিন্দুর হাতে জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আলতুনিয়া ও রাজিয়া মৃত্যুবরণ করেন। (Nizami: 1992: 242) সম্ভবত এরা একদল দস্যু ছিল।

 নয়

পুরনো দিল্লির তুর্কমান তোরণের কাছে মহল্লা বুলবুলী খানাতে চিরনিদ্রায় আজও শায়িত আছেন দিল্লির ইতিহাসের একমাত্র নারী সুলতানা রাজিয়া। তবে তার সমাধিস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। হরিয়ানার কাইথালেও তার একটি সমাধি আছে। ১৯৩৮ সালে ইংরেজ ভাইসরয় লিনলিথগো (Victor Alexander John Hope, 2nd Marquess of Linlithgow, 1887-1952) এই সমাধিপ্রাঙ্গণ দেখতে এসেছিলেন। রাজিয়ার আরেকটি সমাধি আছে রাজস্থানের টোঙ্ক-এ।

জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা লিখেছেন, ১৪০০ সালে যখন তিনি ভারত সফরে আসেন, দিল্লিতে রাজিয়ার সমাধি প্রাঙ্গণকে তিনি আবিষ্কার করেন এক তীর্থক্ষেত্র রূপে। তার সমাধির উপর তখন একটি চূড়া ছিল। মানুষজন আসত তার কাছ থেকে আশীর্বাদ ও দোয়া নিতে। মৃত্যুর পরও ভারতের জাতীয়তাবাদ বিরোধীদের এবং ন্যায়পন্থিদের কাছে তিনি মা মরিয়ম কিংবা পয়গম্বর তনয়া পবিত্র মা ফাতেমাতুজ্জাহরার এক আদল হয়ে উঠেছিলেন।

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //