স্বাধীন বাংলা বেতার এবং দুঃসাহসের সীমা

যে কেউ বলবেন যে একাত্তরের যুদ্ধের অনেক বৈশিষ্ট্যের ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দুটি-স্বতঃস্ফূর্ততা ও দুঃসাহসিকতা। এই দুটি গুণই দেখতে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যারা গড়ে তুলেছিলেন সেই তরুণদের ভেতরে। তরুণরা দুঃসাহসী হয়, হতে পারে; তাদের ভেতর স্বতঃস্ফূর্ততাও থাকে। কিন্তু যে দশজন তরুণ একত্র হয়েছিলেন বেতার কেন্দ্রটি গড়ে তুলতে তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও দুঃসাহসের উৎস ছিল অভিন্ন, সেটা হলো দেশপ্রেম। 

উদ্যোগটা প্রথমে নিয়েছিলেন তিনজন। পরস্পরের পরিচিত বন্ধুই বলা চলে, বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনজনই। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। একাত্তরের ২৬ মার্চের বিধ্বস্ত ও ভয়ঙ্কর সকালবেলাতে তারা ভাবছিলেন কী করা যায়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে ব্যবহার করে স্বাধীনতার কথা প্রচার করা যায় কিনা-এ চিন্তা তাদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু কেন্দ্রটি শহরের একেবারে ভেতরে। পাকিস্তানি হানাদারেরা সহজেই আক্রমণ করতে পারবে এই বিবেচনা থেকে শহরের বাইরে কালুরঘাটে গিয়ে সেখানকার ট্রান্সমিটারটি ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করেন। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক। কী ঘটতে যাচ্ছে তা জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরুই হয়নি। 

কোথাও বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা ছিল না। সবটাই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্তিকর। এরই ভেতর তারা নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বেতার কেন্দ্র চালু করবেন। অন্য কয়েকজন এসে যোগ দিয়েছিলেন; কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০। তবে তারা যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করতে যাচ্ছেন সেটা তারা জানতেন। 

কী প্রচার করবেন সে বিষয়ে মোটেই পরিষ্কার ছিলেন না তারা। সবটাই ছিল অগোছালো। আসলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা ব্যাপারটাই ছিল অত্যন্ত অগোছালো। পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল না, প্রস্তুতিও ছিল না। প্রতিরোধ যা ঘটেছে তার সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত ও পরস্পরবিচ্ছিন্ন। লোকে ব্যারিকেড তৈরি করেছে, অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট কাছে থাকলে সেদিকে ছুটে গেছে, গ্রামের মানুষ শহরত্যাগী মানুষদেরকে সাহায্য করেছে এবং কেউই ভেবে পায়নি ঠিক কী করতে হবে। ব্যর্থতা ছিল 

নেতৃত্বের। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনো প্রকার কর্তব্যনির্দেশ ছিল না। স্থানীয় নেতারা ছিলেন বিভ্রান্ত, তারা অনেক কিছু করবেন ভেবেছেন; কিন্তু কীভাবে করবেন, কোনটা আগে কোনটা পরে, কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে এসব ঠিক করতে পারেননি। ৭ মার্চের পর থেকে বেতারের কর্মীরা ‘রেডিও পাকিস্তান’ নামটি ফেলে দিয়ে স্থানীয় বেতার কেন্দ্র বলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন। নির্দেশ পেলে তারা হয়তো আরও এগুতেন; কিন্তু নির্দেশ আসেনি। 

কালুরঘাটে তারা বেতার কেন্দ্র চালু করেছিলেন, কারো কাছ থেকে কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ পাননি; ঘর-সংসার, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দিয়ে তারা চলে এসেছিলেন ভেতরের তাড়নাতে। স্বতঃস্ফূর্ততার ভেতর যে অগোছালোপনা থাকে সেটা তাদের কাজের মধ্যে ছিল। তবে তাদের ওপরে যে কর্তৃত্ব করবার মতো কেউ ছিল না সেটার সবটাই যে ছিল অসুবিধার ব্যাপার তাও কিন্তু নয়, তার একটা ভালো দিকও ছিল। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছেন।

পরবর্তীকালে তাদের এই স্বাধীনতাটা খর্ব হয়েছে। প্রথমে খর্ব করেছেন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সরকারি কর্তৃপক্ষ, পরে সরাসরি না হলেও চোখ রেখেছে ভারত সরকার। ভারত সরকারের একজন পরামর্শদাতা বেতার ভবনে এসে অনুষ্ঠানসূচি দেখতেন, পরামর্শ দিতেন, এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় বেতার ভবনে চলে এসে সাময়িকভাবে অফিস পর্যন্ত খুলেছিলেন। সেটাও ঘটেছে পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজনেই। 

আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপটা ছিল আরও স্পষ্ট। চট্টগ্রামে থাকতে তাদের এক নেতা নিজের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতারে ঘোষণা প্রচার করে গেছেন, কিন্তু বেতারের কর্মীরা কোথায় থাকবেন কীভাবে থাকবেন সে নিয়ে কোনো প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করেননি। পরে অবশ্য তিনি কৃতিত্ব দাবি করেছেন যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নাকি তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেতার কেন্দ্রটি যখন কলকাতায় চলে গেছে তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানাভাবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা হয়েছে। যুদ্ধটাকে জাতীয় যুদ্ধ হিসেবে না দেখিয়ে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধ হিসেবে প্রচারের কথা বলা হয়েছিল।

বেতার কর্মীদের আপত্তির দরুন সেটা করা সম্ভব হয়নি। কথিকা প্রচারকদের তালিকা এবং কথিকার পাণ্ডুলিপি পূর্ব-অনুমোদনের প্রথাটা অবশ্য চালু করা সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধটা ছিল প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধ। কিন্তু জনযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। অজুহাত এই যে শব্দটি মাও সে তুঙ ব্যবহার করতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ নামে একটি সিগনেচার টিউন ব্যবহার করা হতো। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সেটা এসেছিল।

নভেম্বরের দিকে, যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পরিণতির অভিমুখে এগুচ্ছে তখন, সেটা বাদ দিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ ব্যবহার করার নির্দেশ এসেছিল। আগের গানের আপত্তির কারণ ছিল এই যে, ওর শেষ পঙ্ক্তি কটি ছিল এই রকমের-‘ভুখা আর বেকারের মিছিলটা যে ঐ/দিন দিন শুধু বেড়েই যাবে/রোদে পুড়ে জলে ভেসে অসহায় হয়ে/ফুটপাথে তারা ঠাঁই পাবে।’ দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে এ সময়ে এসব অলক্ষণে কথা কেন, তাও আবার স্বাধীন বাংলা বেতারে? চলবে না, চলেনি। 

চরিত্রগতভাবে যুদ্ধটা জনযুদ্ধ হলেও এতে সবার অংশগ্রহণের কিন্তু সুযোগ ছিল না। যে দশজন দুঃসাহসী তরুণ যোদ্ধা বেতার কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের কারোরই কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না। তারা আওয়ামী লীগের ছিলেন না, বামপন্থি দলগুলোর কোনোটির সঙ্গেই তাদের সংশ্রব ছিল না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ 

না-থাকাটা তবু যা হোক সহনীয় ছিল, বামপন্থার দিকে ঝোঁক যদি কারো ব্যাপারে সত্য হতো তবে তিনি অসুবিধায় পড়তেন। অন্ততপক্ষে তাকে সরে দাঁড়াতে হতো, যেমন হয়েছিল মোজাফ্ফর ন্যাপের কর্মীদেরকে। 

তাদের পাঁচশ কর্মী আগরতলায় অপেক্ষায় ছিলেন, প্রশিক্ষণ নেবেন এবং যুদ্ধে যাবেন এ আশায়। কিন্তু প্রশিক্ষণের জন্য তারা গৃহীত হননি। পরে তাদেরকে স্বতন্ত্র ক্যাম্পে থাকতে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ যেটুকু পান তাও স্বতন্ত্রভাবে। আর সেটাও সম্ভব হয়েছে সিপিআই-এর সহযোগিতার কারণে; সিপিআই-এর পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। জনযুদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধটার চরিত্র দাঁড়াতে পারতো জাতীয় মুক্তির সর্বদলীয় সংগ্রামের। সেই চরিত্র যদি স্বীকৃতি পেত তবে তার প্রতিফলন ঘটতো স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানেও, এবং অনুষ্ঠানগুলো অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হতো, তারা আরও ব্যাপক উদ্দীপনা ও আশা-ভরসা সৃষ্টি করতে সমর্থ হতো। 

দুর্ভাগ্যক্রমে তেমনটা ঘটেনি। কেন যে ঘটলো না তার একটি উল্লেখ বেলাল মোহাম্মদের বই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’তে পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের ভেতর বেলাল মোহাম্মদই ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে। তার বইতে বলা হচ্ছে যে-বামপন্থি নেতাদের একাংশ চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ঐক্য গড়বার পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বামপন্থিরা সকলকে মিলে একটি ঐক্য ফ্রন্টে মিলিত করতে। কিন্তু জানা গেছে যে চীনপন্থিদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গড়তে মণি সিংহ রাজি হননি। “কারণ তাতে দেবীর সায় নেই।” বোঝাই যাচ্ছে, দেবী হচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী। 

তবে এটা জানি যে শেষ পর্যন্ত একটি পরামর্শ পরিষদ গঠিত হয়েছিল, যার সভাপতি করা হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে; কিন্তু পরিষদের একটির অধিক বৈঠক বসেনি, এবং দায়সারা গোছের পরিষদটি গঠনের পেছনে হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ কাজ করেছিল। ভারতের কংগ্রেস সরকার এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষ, উভয়েরই ভয় ছিল বামপন্থিরা ঢুকে পড়লে নেতৃত্ব বামপন্থিদের হাতে চলে যাবে। সে ভয় আওয়ামী লীগের যে ছিল না তা নয়। মুজিববাহিনী অকারণে গঠিত হয়নি। 

স্বাধীনতা পেলে উদ্ভাবনীশক্তি কেমন বিকশিত হতে পারে সেটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের কাজের ভেতর সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। নিজেদের কর্মস্পৃহার বাইরে তাদের জন্য কোনো বস্তুগত সমর্থন ছিল না। বেতারের ব্যাপারে তাদের যে অভিজ্ঞতা সেটাও ছিল পাকিস্তানি বেতার কেন্দ্রে কাজ করারই। তারা অভ্যস্ত ছিলেন পাকিস্তানি চিন্তাধারার প্রচারে। হঠাৎ করেই তাদেরকে অবস্থান নিতে হয়েছিল সম্পূর্ণ উল্টো। 

এরই মধ্যে তারা দ্রুত গতিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবং সেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন। যেমন নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। কোথা থেকে প্রচার হচ্ছে শত্রুপক্ষ সেটা যেন না জানতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার হবে। শুরুতে একজন নারী ঘোষিকা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিতে চেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। তাকে তারা সঙ্গে নিতে পারেননি; পাছে রক্ষণশীল শ্রোতারা বিরূপ হয়।

সম্প্রচার কেন্দ্রটি ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। রক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য ২৭ তারিখেই তারা পটিয়াতে জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে সহায়তা চেয়েছিলেন। জিয়া ইতিমধ্যেই তাদের অনুষ্ঠান শুনেছেন; তাই তাদেরকে পেয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। নিজ বাহিনীর কিছু সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছেন কালুরঘাটে। ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে, পাহারার ব্যবস্থাও করা গেছে। 

বেলাল মোহাম্মদ দেখলেন যুদ্ধটা যেহেতু সশস্ত্র তাই সেনাবাহিনীর কাউকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করলে ভালো হয়। জিয়াকে তিনি বলেছিলেন, আমরা তো সবাই মাইনর, মেজর হিসেবে আপনিই বরঞ্চ স্বকণ্ঠে কিছু বলুন। তার বলার ভেতর কিছুটা কৌতুক ছিল, জিয়া কথাটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে নিজের হাতে লিখে, নিজের পরিচয় দিয়ে, স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। কথাগুলো তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন, এবং নিজের নামেই ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। বেলাল মোহাম্মদের পরামর্শে on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman যোগ করে দিলেন।

সেটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংশোধন। পরে বক্তব্যটি বাংলা অনুবাদ প্রচার করা হয়েছে। সংবাদ বুলেটিনেও কাভারেজ দেওয়া হয়েছে জিয়াউর রহমানের বিবৃতি হিসেবে। ওই বিবৃতি ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। প্রতিক্রিয়া ঘটেছে বৈদ্যুতিক। সবাই যে শুনতে পেয়েছে তা নয়, কিন্তু যারা শুনেছে তাদের কাছ থেকে অন্যরা শুনেছে। জনে জনে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশি বেতারেও সেটি প্রচার পেয়েছে। বিদেশে বাঙালিরাও জানতে পেরেছে। বিলেতে মেজর জিয়াকে কেউ কেউ মেজর জিয়া খান বলেও মনে করেছে। সর্বত্র আশার সঞ্চার হয়েছে। প্রতিরোধ জোরদার হয়ে উঠেছে। 

স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভাবনার আরও ঘটনা ঘটেছিল। পাকিস্তানি হানাদারেরা বোমা বর্ষণ করে কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করে দেয়। সেটি ৩০ মার্চের দুপুরের ঘটনা। বেতার কেন্দ্রটির সেখানেই ইতি ঘটতে পারত। কর্মীরা কিন্তু দমেননি। কালুরঘাট কেন্দ্রের এক কিলোমিটারের একটা অতিরিক্ত ট্রান্সমিটার ছিল। সেটিকে খুলে একটি মাইক্রোবাসে চাপিয়ে তারা রওনা হয়েছিলেন মুক্তাঞ্চলের খোঁজে; প্রচারের কাজ নতুন করে শুরু করবেন এই পরিকল্পনা নিয়ে।

ওই ট্রান্সমিটারটি অবশ্য ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়নি, আগরতলাতে গিয়ে তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি ট্রান্সমিটার পেয়েছিলেন। সেটি ব্যবহার করে এপ্রিল মাসের ৩ তারিখে তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করেন। এখান থেকে অনুষ্ঠান প্রচার চালু ছিল মে মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত। তারপরে শুরু হয় কলকাতা থেকে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্বের সম্প্রচারের। 

বেতারের ওই ১০ জনের অবকাশ ছিল না বিশ্রামের। পেছনে ফেরার কোনো পথ ছিল না। ফেরার কথা তারা ভাবেনওনি। জামাকাপড় ঠিক ছিল না। গায়ে যা ছিল তা পরেই থেকেছেন। দিনের পর দিন। এপ্রিলের ১১ তারিখে আগরতলায় প্রথম নতুন জামাকাপড় কেনেন। খাবারদাবারের কষ্ট ছিল ভীষণ। আগরতলায় প্রথমে থাকতেন বাঁশের ঘরে। খবর লিখতেন ঘাসের ওপর বসে। স্বাস্থ্য এমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ লজ্জা পেয়েছে। বিপরীতে নেতারা ছিলেন রেস্ট হাউসে। তাদের জন্য কষ্ট ছিল না থাকা-খাওয়ার। 

এরই মধ্যে খবর সংগ্রহ, খবর তৈরি, কথিকা লেখা-সব কিছু করতে হয়েছে। উদ্ভাবন শক্তির চমৎকার ব্যবহার ঘটিয়ে মুস্তাফা আনোয়ার একটি স্লোগান দাঁড় করিয়েছিলেন, “ওরা মানুষ হত্যা করেছে-আসুন আমরা পশু হত্যা করি।” অত্যন্ত উপযোগী একটি স্লোগান। সে জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের ভয়াবহ একটি মুখাবয়ব এঁকে শিল্পী কামরুল হাসান, তার নিচে ওই স্লোগানটি বসিয়ে দিয়েছিলেন। এ ধরনের উদ্ভাবনা কলকাতা থাকা অবস্থায় অবশ্য আর সম্ভব হয়নি। তার কারণ আমলাতান্ত্রিক নিরুৎসাহিতকরণ।

কলকাতায় রেকর্ড করা হয়েছিল গুরুসদয় দত্তের একটি ব্রতচারী গান, “মানুষ হ মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ/অনুকরণ খোলস ভেদি/কায়মনে বাঙালি হ”। গানটা মোটেই জমেনি। তিন চারবার প্রচারের পর সমালোচনার মুখে রেকর্ডটি বাতিল করা হয়েছিল। স্লোগান হিসেবে ‘আসুন আমরা পশু হত্যা করি’র সঙ্গে ‘আবার তোরা মানুষ হ’র তুলনা করলে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতার সঙ্গে কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণের ব্যবধানটা বোঝা যায়। একাত্তরে বাঙালিকে মানুষ হতে উপদেশ দেওয়া পরিহাসের শামিল ছিল বৈকি। 

হস্তক্ষেপ অবশ্য অন্য মহল থেকে ঘটেছে। বেতার কেন্দ্রটি চালু করার সময়ে কী নাম দেওয়া যায় সে প্রশ্ন উঠেছিল। স্বভাবতই। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেলাল মোহাম্মদ কাগজে নাম লিখেছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সহযোদ্ধা আবুল কাসেম সন্দ্বীপের পরামর্শ ছিল সঙ্গে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি থাকুক। সেটাও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা তাই ‘বিপ্লবী’ শব্দটি যোগ করে দিয়েছিলেন। তারপরেও প্রচারণায় কেউ দ্বিধা করতে পারে এমন বিবেচনায় আবুল কাসেম সন্দ্বীপ নিজেই মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ কিন্তু বেতারের ওই বিপ্লবী চরিত্রটি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, এমনকি নামেও নয়।

৩০ তারিখে পাকিস্তানিরা হানা দিয়েছিল, তার আগেই, ২৮ তারিখেই, বিদ্রোহী বাঙালি সেনা অফিসারদের পরামর্শেই বিপ্লবী নামটি খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। সেনা অফিসারদের আপত্তিটা মোটেই অন্যায় বলা যাবে না; তারা বিদ্রোহ করেছেন ঠিকই, তবে তাদের লক্ষ্য তো বাংলাদেশকে স্বাধীন করা পর্যন্তই; সেখানে বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতাটা কোথায়? সেই সময়ে নাম থেকে বিপ্লবকে নামানোর পরামর্শটা সামরিক বাহিনীর দিক থেকে যদি না-ও আসতো, তবে অল্প পরে হলেও রাজনৈতিক নেতাদের দিক থেকে যে আসতো সেটা নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। 

এ প্রসঙ্গে আজ থেকে একশ বছর আগে কাজী নজরুল ইসলামের স্বপ্নের কথাটা স্মরণে আসে। নজরুল শুরু করেছিলেন বিদ্রোহী হিসেবেই। শুরুতে তিনিও সামরিক বাহিনীতেই ছিলেন; কিন্তু অচিরেই বিদ্রোহী নজরুলের স্বপ্ন দাঁড়িয়েছিল সমাজ বিপ্লবের। তার ওপর প্রভাব আছড়ে পড়েছিল রুশ বিপ্লবের। কিন্তু বিপ্লবী অবস্থানে তিনিও শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি; শোকে রোগে দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়ে, এবং দেশে বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রসরমাণতা না দেখতে পেয়ে তিনি অকালে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। সুস্থ থাকলে স্বাধীনতার নামে দেশভাগ যে তাকে অসুস্থ করে ফেলতো এটা অনুমান করা যায়। বিপ্লবী হওয়া এবং হলে টিকে থাকা কোনো সহজ কাজ ছিল না। 

দুই

একাত্তরের যুদ্ধে ঘরে-বাইরে বহু ধরনের শত্রু কর্মরত ছিল। পাকিস্তানিরা ছিল, রাজাকারেরা ছিল, ছিল অবাঙালিরা। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গেছেন এমন বাঙালিরাও বাঙালিদের হাতেই বিপদে পড়েছেন। প্রাণ হারানোর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। বিদ্রোহী বেতার কর্মীরা শঙ্কার ভেতর থাকতেন পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বিশ্বাসযোগ্য আক্রমণের; তাদের একজনের অবয়বে বাঙালিত্বের ছাপ না থাকায় ভীষণ বিপদ ঘটেছিল।

অন্যরা ছুটে এসে রক্ষা করেছেন, নইলে তিনি শহীদ হতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার একেবারে প্রাথমিক স্তরে অত্যন্ত সাহসী ও সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন মাহমুদ হোসেন। থাকতেন তিনি ইউরোপে, গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দেশপ্রেমিক অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রামে চলে এসেছিলেন শিল্পকারখানা গড়বেন বলে। একাত্তরে ব্যবসা ভুলে যুক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে তার যাতায়াত ছিল, সেই সূত্রে বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

২৬ মার্চ রাতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনে স্থির থাকতে পারেননি, রাত ১০টায় চট্টগ্রাম বেতার ভবনে গিয়ে পিস্তলের মুখে প্রকৌশলীদেরকে সহায়তা করতে বাধ্য করে ইংরেজি ভাষাতে একটি বক্তব্য প্রচার করেন, তাতে বিশ্ববাসীকে ‘হ্যালো ম্যানকাইন্ড’ বলে সম্বোধন করে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা জানিয়ে, বিশ্ববাসীর সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। তার আরও আকাঙ্ক্ষা ছিল ভারতে গিয়ে পূর্বপরিচিতদের কাজে লাগিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসবেন। সীমান্ত পার হতে গিয়ে ধরা পড়েন। না, পাকিস্তানিদের হাতে নয়; বাঙালিদের হাতেই। অবয়বের ত্রুটি এবং পকেটে বিদেশি মুদ্রা থাকার কারণে দুজন সহযোদ্ধাসহ প্রাণ হারান। তিনজনের লাশই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

বিরোধ ছিল বাঙালিদের নিজেদের মধ্যেও। কলকাতায় থাকা অবস্থায় বেলাল মোহাম্মদ ভারতীয়দের মুখেই শুনেছেন যে, নেতারা সবাই যে মুজিবভক্ত নয় সেটা ভারতীয়রা বিলক্ষণ জানেন। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী এক মুসলমান ভদ্রলোক বেলাল মোহাম্মদকে জানিয়েছেন যে আওয়ামী লীগের বড় এক নেতা নিজের জীবনী লেখানো নিয়ে বিশেষ রকমের তৎপর হয়ে পড়েছিলেন। ছোট ছোট ঘটনা, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। কলকাতার অবাঙালি মুসলমানরা জয় বাংলার লোকদের মোটেই পছন্দ করত না, তাদের কারো কারো আত্মীয়-স্বজন ছিল পূর্ববঙ্গে; সুযোগ পেলেই তারা নানা অভিযোগ তুলে কটুকথা বলত।

সাতচল্লিশের পরে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে সেই হিন্দু বাঙালিরাও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে ছাড়ত না। এসব বিরূপতা উপেক্ষা করে বেতারকর্মীদেরকে কাজ করতে হয়েছে। আগরতলায় থাকতে তাদের চলাফেরা ছিল সীমিত; তারা হিন্দু নাম গ্রহণ করেছিলেন। একসময়ে তাদের জন্য রান্নাবান্না করতেন যে মাসিমা, তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে সাতচল্লিশে বিতাড়িত হিন্দু শরণার্থী। খাবার সময়ে তার কাছে এক গ্লাস পানি চাইতে গিয়ে একজন বেতারকর্মী বিপদে পড়েছিলেন, সহকর্মীর প্রত্যুপন্নমতিত্বের সহায়তায় কোনো মতে মান-ইজ্জত বাঁচিয়েছেন। 

ওদিকে যে লড়াইটার ভিত্তি ছিল ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ তার প্রচার-প্রচারণায় এবং ইস্তেহারে আল্লাহর ওপর ভরসার কথা যে থাকত না এমন নয়। খুবই থাকত। কোনো কোনো ইস্তেহার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ে শোনানোও হয়েছে। উল্লেখ আছে বেলাল মোহাম্মদের বইতে। যেমন আগরতলা থেকে এপ্রিল-মে মাসে প্রচারিত একটি ইস্তেহার শুরু করা হয়েছিল এভাবে, “খোদাতায়ালার ইচ্ছায়, আমরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবই।” ইস্তেহারের ভেতরে বলা হয়েছে, “যতই দিন যাবে আমাদের মুক্তিবাহিনী ততই শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং অধিক সংখ্যায় পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করবে। আল্লাহ্র অসীম অনুগ্রহে আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করবই।” 

পাকিস্তানি হানাদাররাও কিন্তু নিজেদেরকে আল্লাওয়ালা বলে বড়াই করতো। পরবর্তী একটি ইস্তেহারেও একই ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায় হচ্ছে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহতালার সাহায্য, বাংলাদেশের জনসাধারণের মনোবল, মুক্তিলাভের দৃঢ় সংকল্প, শত্রুসংহারে অবিচল প্রতিজ্ঞা।’ শেষ করা হয়েছে এভাবে, “সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার ওপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন। স্মরণ করুন, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন: অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর। বিশ্বাস রাখুন: আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।” 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচির দিকে তাকালে দেখবসেখানে কোরান ও তার অনুবাদ পাঠ ছিল প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান; শনিবার ছাড়া প্রতিদিন প্রচারিত হতো ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ নামের একটি কথিকা; এবং সপ্তাহে একদিন করে থাকতো গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ।

কলকাতায় গিয়ে বেলাল মোহাম্মদের বিশেষ আগ্রহ ছিল কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে দেখা করার। মুজফ্ফর আহমদ তার এলাকারই লোক, সম্পর্কে আত্মীয়ও বটেন, তবে তার মনে পড়েছে যে ছেলেবেলায় লোকে বলত যে মুজফ্ফর আহমদ একজন নাস্তিক। তিনি এটাও স্মরণ করেছেন যে ১৯৬৫-এর যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে পুঁথিপাঠের ধরনে তিনি নিজের লেখা ভারতবিরোধী ‘খবর’ প্রচার করতেন। শুরুটা করতেন এভাবে, ‘আহা আল্লানবী কর মদদ/এখন খবর বলি, বেলাল মোহাম্মদ।’ তার সেই পুঁথিপাঠ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।

ধর্মের সঙ্গে প্রচারকার্যকে মিশিয়ে ফেলাটা ১৯৬৫তে স্বাভাবিক ছিল; ১৯৭১-এ যে সেই রীতি পরিত্যক্ত হয়েছিল তা বলা যাবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিদিনের অনুষ্ঠান শুরু করা হতো শ্রোতাদের সালাম জানিয়ে, শেষ করা হতো খোদা হাফেজ বলে। এ নিয়ে ভারতীয় পরামর্শক আর এন আচারিয়া মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন। দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন প্রথম কয়েক দিন ঢাকা থেকে প্রচারিত বেতারে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করার রীতি একেবারেই বাদ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু পরে আবার তা ফেরত এসেছে, যথারীতি। 

একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কবি আবদুস সালাম ব্যাকুলভাবে ছুটে গিয়েছিলেন বেতারকর্মীদের খোঁজে, উদ্দেশ্য বেতারে ভাষণ পাঠ করা। ভাষণটিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল সোডার বোতল, মরিচের গুঁড়া, বিজলি বাতির বাল্ব-এ ধরনের ঘরোয়া অস্ত্র যার কাছে যা আছে তা নিয়ে শত্রু সেনাকে আক্রমণ করার। বিশেষ ভরসা হিসেবে তিনি উদ্ধৃত করেছেন কোরানের বাণী।

তিন

আধুনিক যুগে বেতার যে কত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ একাত্তরে পাওয়া গেছে। হানাদারদের আচমকা আক্রমণে মানুষ যখন দিশেহারা তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যে ভূমিকা নিয়েছিল সেটা কোনো দিক দিয়েই সামান্য নয়। বেতার ছিল অন্ধকার ভেদ করে ফুটে ওঠা একটা আশার আলো। বোঝা গিয়েছিল সব কিছু হারিয়ে যায়নি, প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে। দেশের ভেতরে কোথায় কী ঘটছে তার একটা ধারণা পাওয়া গেল। বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে ভিন্ন স্বর শোনা গেছে। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধ চলছে। প্রবাসী সরকারের নির্দেশ পৌঁছে যাওয়া শুরু করল মানুষের কাছে। পাকিস্তান সরকার তাদের বেতারে দিনরাত যে সব মিথ্যা কথার প্রচার চালাচ্ছিল তার জবাবও আসছিল এই বেতার কেন্দ্র থেকে। 

বেতার কেন্দ্রটিকে হানাদারেরাও কম গুরুত্ব দেয়নি। প্রথমে তারা প্রচার করেছিল হুগলী নদীর মোহনায় একটি জাহাজ থেকে বেতারের আওয়াজ ছড়ানো হচ্ছে; সবটাই ভারতীয় ষড়যন্ত্র। কিন্তু সে প্রচারে তাদের নিজেদেরও আস্থা ছিল না; তারা অকুস্থল খুঁজে বের করেছিল। এবং বোমারু বিমান পাঠিয়েছিল বেতার কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করার জন্য। এই কাজটিকে তারা তখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বস্তুত কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্রের ওপর ১০ মিনিট ধরে একটানা বোমা বর্ষণ ছিল বাংলাদেশে তাদের প্রথম বিমান হামলা। প্রচার কেন্দ্রটিকে অচল না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায়নি।

কিন্তু যে বিপ্লবী সম্ভাবনা নিয়ে বেতার কেন্দ্রটি আত্মপ্রকাশ করেছিল তা টেকেনি। রাজনৈতিক জনযুদ্ধটি তার বৈপ্লবিক চরিত্র সূচনাতেই হারিয়ে ফেলেছিল। নাম থেকে বিপ্লবী অভিধার প্রস্থান কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, এটিই ছিল স্বাভাবিক; জাতীয়তাবাদী লড়াইটা সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ে পরিণত হোক এমনটা প্রভাবশালী দুটি মহলের কোনোটিই চায়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক নেতৃত্ব, এই দুই মহলের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল এটা ঠিক; সামরিক নেতৃত্বের কোনো কোনো অংশ এমনও চিন্তা করেছে যে যুদ্ধের নেতৃত্ব একচ্ছত্ররূপে আওয়ামী লীগের হাতে থাকা উচিত নয়, কারো কারো এমনও ইচ্ছা ছিল যে যুদ্ধ শেষ হলে ক্ষমতা চলে যাবে সামরিক বাহিনীর হাতে, তারা নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, করে ক্ষমতা তুলে দেবে নির্বাচিতদের হাতে।

কিন্তু সামরিক-বেসামরিক সব পক্ষই একমত ছিল-সামাজিক বিপ্লবের বিরোধিতার ব্যাপারে। যুদ্ধের সময়ে সামরিক আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বপরায়ণতা প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী সময় স্বাধীন বাংলাদেশে তারা ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিজেরাও নিহত হয়েছে। ওদিকে যে জাতীয়তাবাদী শক্তি যুদ্ধকালে নেতৃত্বে ছিল এবং পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করেছে তাদের নিজেদের ভেতর বিরোধ ছিল অমীমাংসেয়, যে জন্য তারা পারস্পরিক শত্রুতাতে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রধান শত্রু ছিল জনগণের বিপ্লবী চেতনা। 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে বিপ্লবী নাম দেওয়াটাও কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না, স্বাধীনতা মানুষ আগেও একবার পেয়েছিল, সেই স্বাধীনতা ছিল শুধু নামেরই, দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা কিছুই বহন করে আনতে পারেনি, দুর্ভোগ ভিন্ন। জনগণের উপলব্ধিতে একাত্তরের যুদ্ধ তাই শাসক বদলের ছিল না, ছিল সমাজবদলের। অর্থাৎ বিপ্লবের। বেতার কর্মীদের অগ্রসর অংশ সেই উপলব্ধিকেই ধারণ করতেন।

যুদ্ধ জনগণই করেছে; কলকাতায় যারা চলে গিয়েছিলেন, কিংবা বাধ্য হয়েছিলেন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে, তারা কিন্তু যুদ্ধ করেননি, অধিকাংশই সময় কাটিয়েছেন হানাদারদের বর্বরতা এবং নিজেদের দুর্ভাগ্যকে অভিলাষ দিয়ে; কিছু ছিলেন যারা সুবিধা ভোগ করেছেন এবং হতাশায় ভুগেছেন। যুদ্ধের পরে সুবিধা যা হওয়ার ছিল সেগুলো মূলত এদেরই করতলগত হয়েছে। 

৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেদিন থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামও বদলে যায়। নতুন নাম দাঁড়ায় ‘বাংলাদেশ বেতার’। অর্থাৎ সেদিন থেকেই এটি পুরোপুরি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। বিপ্লবী তো নয়ই, বিদ্রোহী চরিত্রটাও আর অবশিষ্ট রইল না। বেতারের নিয়মিত কর্মীরা আগেই সরকারি কর্মচারী হয়ে গিয়েছিলেন, এখন পুরোপুরি বেতনভুক হয়ে পড়লেন। দেশে ফেরার পর পোস্টিং, প্রমোশন, ট্রান্সফার-এসব বিষয় সামনে চলে এলো। মুজিবনগরী হাজি এবং দেশীয় অ-হাজিদের ভেতর পার্থক্য দেখা দিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে তো বেতারের নামই বদল করে দেওয়া হয়েছিল।

নতুন নাম হয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ; পাকিস্তানি স্টাইলে। সেই নাম অবশ্য টেকেনি। তবে রাষ্ট্রীয় বেতার ক্রমশ তার গুরুত্ব হারিয়েছে। প্রাইভেট এফএম রেডিও চলে এসেছে, একের পর এক। রাষ্ট্রীয় বেতার জনগণের থাকেনি, মুখপাত্র হয়েছে সরকারের। বার বার সরকার এসেছে এবং চলে গেছে, কিন্তু কোনো সরকারই জনগণের পক্ষের শক্তি হয়নি। বেতারও আর জনগণের মিত্র থাকেনি, একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে যেমনটা ছিল। চরিত্রে ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন ঘটে গেছে। 

যুদ্ধের সময় এটা অস্পষ্ট ছিল না যে ভারতের রাজনৈতিক আগ্রহটা কেবল শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোতে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল ঘোষিত শত্রু পাকিস্তানকে ভাঙা পর্যন্ত। সাময়িক বিবেচনার বাইরে, তাদের স্থায়ী ইচ্ছাটা ছিল পাকিস্তানকে ভাঙারই। ভারতের জন্য যা ছিল শত্রুকে পর্যুদস্ত করা, আমাদের জন্য সেটাই দাঁড়িয়েছিল স্বাধীনতা। এক যাত্রায় পৃথক ফল। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের অনুপস্থিতিটা লক্ষ করার মতো ঘটনা বৈকি। তার প্রতীকী মূল্যও কম নয়। 

পাকিস্তানের পতনের পর বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতীয় আমলারা এসেছিলেন, বেতারে এসেছিলেন একজন পরামর্শক। তারা অবশ্য চলে গেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব কমেনি, দিনে দিনে বরং বেড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যদি বিপ্লবী হতো তাহলে নেতাদের কাজটাও হতো ভিন্ন রকমের।

বিপ্লবের সম্ভাবনার ভেতরে যেমন প্রতিশ্রুতি ছিল মৌলিক পরিবর্তনের, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মুনাফা লোলুপতার তথা শোষণের পরিবর্তে মানবিক করার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভেতরও তেমনি সম্ভাবনা ছিল বেতারকে কেবল পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, দেশপ্রেমকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে গিয়ে দেশবাসীর ভেতর সর্বক্ষেত্রে নতুন সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করার।

বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তো খুব বড় রকমের পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে পারত ওই বেতার কেন্দ্র। পরে টেলিভিশন এসেছে। টেলিভিশনও পারত রেডিওর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে, রেডিও যদি দৃষ্টান্ত স্থাপন করত। কিন্তু রেডিওর বিপ্লবী সম্ভাবনা তো নিঃশেষ হয়ে গেছে সূচনাতেই। 

আড়াই দিনের মাথায়, মার্চ মাসের ২৮ তারিখেই, যেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিপ্লবী শব্দটাকে নামিয়ে ফেলা হয়। ওটি তো কেবল একটি শব্দ ছিল না, ছিল একটি স্বপ্ন। সমষ্টিগত স্বপ্ন।

স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পার্থক্য বিস্তর, কিন্তু মিল নেই এমনটা বলার উপায় নেই। মিলগুলো ক্রমাগত উন্মোচিত হচ্ছে। ধরা যাক গণধর্ষণের ব্যাপার। ওই কাজ পাকিস্তানি হানাদারেরা একাত্তরে করেছে। ক্ষমতার জোরে, এখন বাঙালি দুর্বৃত্তরা করছে। ক্ষমতা আছে বলেই করতে পারছে। পাকিস্তানি আদর্শ ফেরত এসেছে যারা বলছেন তারা ভুল বলছেন। ওই আদর্শ যে বিদায় নিয়েছিল তা তো নয়।

আদর্শ হস্তান্তরিত হয়েছিল মাত্র, পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে চলে এসেছিল বাঙালি শাসকদের হাতে। হয়তো বলা যাবে যে পাকিস্তানি শাসকেরা ছিল অবৈধ, আর বাঙালি শাসকেরা বৈধ। কিন্তু সকল বাঙালি শাসকই কি বৈধ? সামরিক শাসন কি আসেনি? প্রহসনমূলক বৈধ নির্বাচন কি ঘটেনি? এই প্রসঙ্গে বেলাল মোহাম্মদের বইতে উল্লেখিত একটি গল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গল্পটি তিনি মওলানা ভাসানীর মুখে শুনেছিলেন। সেটা এই রকমের, “একটা ছাগলকে তাড়া করেছিল একটা হিংস্র বাঘ।

একজন মৌলবী তখন বাঘের হাত থেকে ছাগলটিকে রক্ষা করেছিলেন। মৌলবী ঘাস-পাতা খেতে দিয়ে ছাগলটিকে তাজা করে তুলেছিলেন। একদিন ছাগলটিকে জবাই করতে উদ্যত হলে ছাগলটি বলেছিল : আপনি সেদিন আমাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন নিজেই আমাকে খাবেন কেন? উত্তরে মৌলভী বলেছিলেন: বাঘ তোমাকে হারাম খেতে চেয়েছিল। আমি তো তোমাকে হালাল করেই খাব।” 

গল্পটির কথা তার মনে পড়েছে ১৬ ডিসেম্বরের পরে, বাংলাদেশে আগত ভারতীয় সেনাদের লুণ্ঠনতৎপরতা দেখে। কিন্তু এটি বাংলাদেশি লুটপাটকারীদের বেলাতেও পুরোপুরি প্রযোজ্য বৈকি। 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি গান শোনানো হতো। সেটির শিরোনাম ছিল ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’ সংগ্রাম সেদিন চলেছিল, আজও চলেছে। ভরসা আসলে সেটাই। বেলাল মোহাম্মদ স্মরণ করেছেন যে, ভারতীয় অফিসাররা তাদেরকে বলত, তোমাদের ওখানে তো দেখছি অনেক উন্নতি হয়েছে, তোমরা খামোখা গোলমালের মধ্যে গেলে কেন? তারা খেয়াল করেনি যে উন্নতির রূপকথার ভেতর একটা দৈত্যও ছিল, রূপকথার ভেতর দৈত্যরা সাধারণত থাকেই। সেই দৈত্যটার নাম বৈষম্য।

বাঙালিরা সেদিন ওই দৈত্যটার বিরুদ্ধেই লড়ছিল। সে সময়ে ওই দৈত্যটা ছিল আঞ্চলিক বৈষম্যের, এখন দাঁড়িয়েছে শ্রেণি-বৈষম্যের। শ্রেণি-বৈষম্য সেদিনও ছিল, কিন্তু সেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের নিচে; বাঙালি অর্থনীতিবিদরা যার সময়োপযোগী নাম দিয়েছিলেন দুই অর্থনীতি। এখন এক অর্থনীতির ভেতর পরিষ্কারভাবে দেখা দিয়েছে দুই শ্রেণি ধনী ও দরিদ্র। এখনকার সংগ্রামটা তার বিরুদ্ধেই। এই সংগ্রাম চলছে, চলবে। দেশপ্রেমিকেরা লড়বে।  

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //