কে-পপ ঝড়

কে-পপ মানে কোরিয়ান পপ। মূলত কোরিয়ান পপকে সংক্ষেপে বোঝাতে কে-পপ লেখা বা বলা হয়। মূলত ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে এই নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। আর সারা বিশ্বে এখন কোরিয়ান পপের তরঙ্গ চলছে। কে-পপ ব্যান্ডগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে সেই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে কোরিয়ান সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিচ্ছে। তবে এই তরঙ্গ একদিনে শুরু হয়নি। এর পেছনে আছে কঠোর অধ্যবসায় ও দীর্ঘ ইতিহাস।

জানা যায়, ১৯৯০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক স্তরে তাদের আনাগোনার গোড়াপত্তনও শুরু হয়। দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে সেই সময় সেন্সরশিপ আইনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনে দেশটির সরকার। সেই প্রথম আন্তর্জাতিক বিনোদন জগতে পদার্পণ করে দক্ষিণ কোরিয়া। এরপর পাশ্চাত্য পপে প্রভাবিত হয়ে ১৯৯২ সালে সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজের মাধ্যমে কে-পপের যাত্রা শুরু হয়।

তারা কোরিয়ান পপ সংগীতে র‌্যাপ, রক ও নাচ অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে কোরিয়ার বিখ্যাত তিনটি মিউজিক লেবেল এসএম, ওয়াইজি এবং জেওয়াইপি, প্রায় ৫ বিলিয়নের কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি আজ যাদের হাতের মুঠোয়। কে-পপ দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বাধিক জনপ্রিয় সংগীত। এর পরের অবস্থানে আছে পশ্চিমা পপ। কিন্তু সেখানে আরও অনেক জনপ্রিয় দেশীয় সংগীত শৈলী আছে। সেখানে প্রবীণরা কোরিয়ান ট্রটকে বেশি উপভোগ করে। কোরিয়ান ট্রট হলো দেশটির জনপ্রিয় সংগীতের একটি পুরনো মাধ্যম। কিন্তু কে-পপ সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল। একই সঙ্গে বিশ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের ফ্যান বেস গড়ে উঠছে।

যার হাতে বিখ্যাত হয় কে-পপ

১৯৬২ সালে শিন জুং-হিউন কোরিয়ার প্রথম রক ব্যান্ড গড়ে তোলেন। তারাই কোরিয়ার প্রথম রক গান ‘দ্য ওম্যান ইন দ্য রেইন’-এর স্রষ্টা। যা প্রাথমিকভাবে সবাইকে বিটলসের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে ১৯৯২ সালে সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজের উত্থান সমসাময়িক কে-পপ ব্যান্ডগুলোর বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। তারা কোরিয়ান সংগীতে র‌্যাপ ও আমেরিকান হিপ-হপ কনভেনশন অন্তর্ভুক্ত করে বিপ্লব ঘটিয়েছিল।

সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সক্রিয় একটি দক্ষিণ কোরিয়ান ব্যান্ড ছিল। এই ব্যান্ডের তিন সদস্য ছিলেন। তারা হলেন-সিও তাইজি, ইয়াং হিউনসুক এবং লি জুনহো। তারা পাশ্চাত্য সংগীতের বিভিন্ন শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ তাদের কাজে খুবই সফল ছিল। তারাই দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সংগীতে র‌্যাপ ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয় তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সংগীতের মাধ্যমে সমাজকে নানাভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ধারণা করা হয় তাদের এই ধারণা থেকেই কে-পপ দ্রুত সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ব্যান্ডটি ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে সোল মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে গ্র্যান্ড পুরস্কার জিতেছিল। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে বিলবোর্ড রিপোর্ট করেছিল, এই ব্যান্ডের প্রথম তিনটি অ্যালবাম ১ দশমিক ৬ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল। তাদের চতুর্থ অ্যালবামটি প্রায় ২ মিলিয়ন বিক্রি হয়েছিল। তাদের চারটি অ্যালবামই দক্ষিণ কোরিয়ায় সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবাম হয়ে উঠেছিল।

কে- পপ তারকা সাই। 

এর আগে ১৯৯১ সালে হেভি মেটাল ব্যান্ড সিনাওয়ে ভেঙে যায়। এরপর সিও তাইজি নৃত্যশিল্পী ও কণ্ঠশিল্পী ইয়াং হিউন-সুক এবং লি জুনোকে নিয়ে সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ ব্যান্ড গড়ে তোলেন। ইয়াং ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম সেরা একজন কণ্ঠশিল্পী। আর লি ছিলেন অন্যতম সেরা নৃত্যশিল্পী।

ব্যান্ড গঠনের পর সিও তাইজি প্রথমবারের মতো এমআইডিআই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি বিভিন্ন এমআইডিআই ধ্বনি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন এবং নতুন ধরনের সংগীত সৃষ্টি করেন। তার এই নিরীক্ষা নাচ/পপ বয় ব্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যম ছিল না। বরং এটি সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজের সাফল্যের মূল টনিক হিসেবে কাজ করেছিল।

মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কে-পপে এমন কী নতুনত্ব ছিল, যা শ্রোতাদের এত আকর্ষণ করে? যদি ভিন্নধর্মী গানের কথা বলা হয়, তাহলে এশিয়ার অন্যান্য দেশের কাছে যথেষ্ট রসদ থাকা সত্তে¡ও তারা কে-পপের ধারেকাছে আসতে পারেনি। কেন-এর মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত শুধু গান নয়, কে-পপ মানে একটা গোটা পারফরম্যান্স। কে-পপ আইডলরা গানের সঙ্গে নাচ, র‌্যাপের মিশেলে স্টেজে যে বিশেষ ম্যাজিক তৈরি করেন, তার সম্মোহন উপেক্ষা করতে পারেনি শ্রোতারা। 

দ্বিতীয়ত কে-পপের নান্দনিকতা, যা এশিয়ার অন্য কোনো সংগীত জগতে নেই। তৃতীয়ত তারুণ্য। প্রতিভা খুঁজে, তাদের ঘষে-মেজে আইডলে পরিণত করার এই কৌশল অন্য কোনো দেশ রপ্ত করতে পারেনি। গান হিট করানোর সব মসলাই রয়েছে প্রতিটি গানে; সেই সঙ্গে রয়েছে ট্যালেন্ট এজেন্সির অসামান্য মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, বছরের পর বছর ধরে কঠোর প্রশিক্ষণ, গ্রুমিং ও নির্ভুল অ্যালগোরিদম।

শীর্ষ কে-পপ ব্যান্ড

দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৪টি 

প্রাথমিক এবং ২৮৬টি ছোট ব্যান্ডসহ তিন শতাধিক কে-পপ ব্যান্ড আছে। এ ছাড়াও প্রতিবছর অনেক ব্যান্ড আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। সর্বাধিক জনপ্রিয় কে-পপ ব্যান্ডগুলো হলো-বিটিএস, সেভেনটিন, আইকন, স্ট্রে কিডস, টুইস, রেড ভেলভেট, ব্ল্যাকপিঙ্ক এবং মনস্টা এক্স।

কে-পপ ব্যান্ডগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড হলো বিটিএস। এটি ব্যাংটান বয়েজ বা বাংতান বয়েজ নামেও পরিচিত। কে-পপ বয় ব্যান্ড বিটিএস ২০১০ সালে গঠিত হয়েছিল। বিটিএসের সদস্যরা হলেন-জিন, সুগা, জে-হোপ, আরএম, জিমিন, ভি এবং জুংকুক। বিটিএস মূলত একটি হিপ-হপ গ্রুপ। তারা বাদ্যযন্ত্রশৈলীকে বিভিন্নভাবে বিকশিত করেছেন। তাদের গানে মানসিক স্বাস্থ্য, তারুণ্য, সংকট-সমস্যা-সমাধানের বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। বিটিএসের ডিসকোগ্রাফি ও কাজ সাহিত্য, দর্শন ও মনস্তাত্ত্বিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত।

বিটিএসই প্রথম কে-পপ গ্রুপ, যাদের গান ইউএস বিলবোর্ডের শীর্ষে স্থান পেয়েছে। এছাড়া ইউএনে প্রথম এশিয়ান গ্রুপ হিসেবে পারফরম্যান্স, আধঘণ্টারও কম সময়ে কনসার্টের টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়া, গ্র্যামি নমিনেশন-যত সময় পেরিয়েছে বিটিএসের মুকুটে একটার পর একটা করে সাফল্যের পালক জুড়েছে। আর তাদের হাত ধরে কে-পপের চাহিদাও অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার আরেকটি বয় ব্যান্ড সেভেন্টিন। প্লেডিস এন্টারটেইনমেন্ট এটি পরিচালনা করে। এই ব্যান্ডটিতে ১৩ জন সদস্য আছেন। তারা হলেন-এস কুপস, জিওনঘান, জোশুয়া, জুন, হোশি, ওয়ানউ, উজি, ডিকে, মিংইউ, জু মিংঘাও, সেউংকোয়ান, ভার্নন ও ডিনো। ব্যান্ডটি ২০১৫ সালের ২৬ মে ‘১৭ ক্যারেট’র মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিল। যেটি যুক্তরাষ্ট্রে সে বছরের দীর্ঘতম চার্টিং কে-পপ অ্যালবাম এবং বিলবোর্ডের ২০১৫ সালের সেরা ১০টি কে-পপ অ্যালবামের একটি ছিল।

দক্ষিণ কোরিয়ার আরেকটি কে-পপ বয় ব্যান্ড আইকন। তারা ১৪৩ এন্টারটেইনমেন্টের অধীনে কাজ করে। মূলত ২০১৫ সালে ওয়াইজি এন্টারটেইনমেন্ট ব্যান্ডটি গঠন করেছিল। এই ব্যান্ডের ছয় সদস্য হলেন-জে, সং, ববি, ডিকে, জু-নে এবং চ্যান। যদিও শুরুতে এটিতে সাত জন সদস্য ছিলেন। ২০১৯ সালে জু-নে ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান।

স্ট্রে কিডস জেওয়াইপি এন্টারটেইনমেন্ট পরিচালিত ব্যান্ড। ২০১৭ সালে একটি রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে তাদের আত্মপ্রকাশ হয়। ব্যান্ডটি আট সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত। তারা হলেন-ব্যাং চ্যান, লি নো, চ্যাংবিন, হিউনজিন, হান, ফেলিক্স, স্যাংমিন এবং আই.এন।

জেওয়াইপি এন্টারটেইনমেন্টের অধীনে পরিচালিত গার্ল ব্যান্ড টুইস। মোট নয় জন সদস্য আছেন টুইসে। তারা হলেন-নায়োন, জিওনগিওন, মোমো, সানা, জিহিও, মিনা, দাহিয়ুন, চাইয়ং এবং জুয়ু। টেলিভিশন অনুষ্ঠান সিক্সটিনের মাধ্যমে টুইস গঠিত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর দ্য স্টোরি বিগিনস দিয়ে ব্যান্ডটির আত্মপ্রকাশ হয়।

আরেকটি গার্ল ব্যান্ড রেড ভেলভেট। ব্যান্ডটি পরিচালনার দায়িত্বে আছে এসএম এন্টারটেইনমেন্ট। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট আইরিন, সেউলগি, ওয়েন্ডি এবং জয়-এই চার সদস্যের মাধ্যমে ‘হ্যাপিনেস’ অ্যালবাম দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল রেড ভেলভেট।

বিটিএস।

দক্ষিণ কোরিয়ার গার্ল ব্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড ব্ল্যাকপিঙ্ক। এই ব্যান্ডটির দায়িত্বে আছে ওয়াইজি এন্টারটেইনমেন্ট। এই ব্যান্ডটির সদস্যরা হলেন-জিসু, জেনি, রোজ এবং লিসা। ২০১৬ সালের আগস্টে একক অ্যালবাম ‘স্কয়ার ওয়ান’ দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল ব্ল্যাকপিঙ্ক। অ্যালবামটির ‘হুইসেল’ ও ‘বুম্বায়াহ’ গান দুটি যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়ার গাওন ডিজিটাল চার্ট এবং ইউএস বিলবোর্ড ওয়ার্ল্ড ডিজিটাল গানের চার্টে তাদের প্রথম শীর্ষ এন্ট্রি। ‘বিশ্বের বৃহত্তম গার্ল ব্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত ব্ল্যাকপিঙ্ক আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে সফল কোরিয়ান গার্ল ব্যান্ড। তাদের ‘বর্ন পিঙ্ক’ দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো গার্ল ব্যান্ডের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবাম এবং দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হওয়া প্রথম অ্যালবাম।

জনপ্রিয় কে-পপ ব্যান্ড

সাত সদস্যের বয় ব্যান্ড বিটিএস বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত নাম। তারা অবশ্যই কে-পপের সবচেয়ে বড় নাম। আইটিউনসের ইতিহাসে প্রথম ব্যান্ড হিসেবে ১০০টি দেশে বিটিএসের আটটি গান শীর্ষস্থান দখল করেছে। এছাড়া ইউটিউব প্রিমিয়ারের জন্য সর্বাধিক ভিউয়ের রেকর্ড ভেঙেছে।

সবচেয়ে ধনী কে-পপ আইডল

সাধারণত কে-পপ শিল্পীদের আইডল বলা হয়। আর বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কে-পপ আইডল পার্ক জিন-ইয়ং। তিনি জেওয়াই পার্ক বা জেওয়াইপি নামেও পরিচিত। ৯০-এর দশকে পার্ক জিন ইয়ং ব্যান্ডে যুক্ত হয়ে কে-পপ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তবে তিনি সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছেন এককভাবে। এই কে-পপ তারকা গট সেভেন এবং জেজে প্রজেক্টের সদস্য ছিলেন। পরে তিনি অভিনেতা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০১২ সালে কে-ড্রামা ‘ড্রিম হাই-২’তে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০১৯ সালে ‘হি ইজ সাইকোমেট্রিক’ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের আগে বেশ কয়েকটিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। চলচ্চিত্রে তার আত্মপ্রকাশ হয় ২০১৬ সালে ‘এ স্ট্রে গোট’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। সিউল স্পেস ও ভেঞ্চার্ড রিপোর্ট করেছে, ২০২২ সালের হিসাবে জেওয়াই পার্কের নিট সম্পদ প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার।

কে-পপ কিং

আন্তর্জাতিক ভোটিং সাইট শাইনিং অ্যাওয়ার্ডস পরিচালিত ‘দ্য কিং অব কে-পপ ২০২২’ জরিপে প্রথম স্থান অর্জন করেন জিমিন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় কে-পপ ব্যান্ড বিটিএসের অন্যতম সদস্য। জিমিন একাধারে একজন র‌্যাপার, গায়ক, গীতিকার, প্রযোজক, উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনার। তিনি সর্বকালের কিং অব কে-পপের মুকুটও পেয়েছেন।

কে-পপ আইডল হতে হলে

এই সাফল্য পাওয়ার জন্য শিল্পীদেরও কম পরিশ্রম করতে হয় না। মাত্র ১০-১২ বছর বয়স থেকে অডিশন দেওয়া, গান ও নাচের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বিশেষ স্কুলে যাওয়া, দিন-রাত রিহার্সাল করা তো রয়েছেই। কোনো বিনোদন সংস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার আগে কাউকে কাউকে কয়েক ডজন অডিশনে অংশ নিতে হয়। চেহারা ও মঞ্চে উপস্থিতির পাশাপাশি গান ও নাচের প্রতিভার ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিকভাবে কে-পপ আইডল নির্বাচন করা হয়। এরপর প্রশিক্ষণার্থীরা গড়ে তিন বছর একটি নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে ব্যয় করেন।

সেই সঙ্গে কীভাবে একজন পপ তারকার মতো জীবনযাপন করতে হয়, কীভাবে চলতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, এসবই হাতে-ধরে শেখানো হয় প্রত্যেক আইডলকে। সব পরীক্ষায় সফল হলে তবেই ভাগ্যে শিকে ছেড়ে কোনো আইডল গ্রুপে পারফর্ম করার। আর এত কঠিন নিয়মতান্ত্রিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলেই পর্দায় ওই ম্যাজিক তৈরি করতে সফল হন তারকারা।

সিও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ।

বিশ্বব্যাপী কে-পপের জনপ্রিয়তা বেড়েছে যেভাবে

কে-পপ এখন আর শুধু কোরিয়ান পপ নেই। বিশ্বব্যাপী রাজত্ব করছে। এই কৃতিত্বের সবচেয়ে বড় দাবিদার বিটিএস। এই কোরিয়ান ব্যান্ডটিই মূলত কে-পপকে বিশ্বের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই ১৯৯০-এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়ায় কে-পপের প্রচলন শুরু হয়। যা গত দশকে পশ্চিমা কানেও জায়গা করে নিয়েছে। কে-পপের এই জনপ্রিয়তার পেছনে আছে মিউজিক স্টাইল, নিখুঁত নাচ, ক্যারেক্টার বিল্ডিং, বিস্তৃত মিউজিক ভিডিও এবং ফ্যান-এনগেজমেন্ট।

কে-পপ এখন একটি বহু বিলিয়ন ডলারের শিল্প এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক বিনিয়োগ। যদিও বেশিরভাগ কে-পপ গান কোরিয়ান ভাষার। তবে বিভিন্ন ব্যান্ডের উপস্থাপন শৈলীগুলো নানাভাবে পরিবর্তিত হয়। কিছু কে-পপ ব্যান্ড সরাসরি পপ সংগীত সরবরাহ করে। বাকিদের মধ্যে হিপ-হপের প্রভাব বেশি থাকে বা ডিস্কো-ইলেকট্রনিক-ডান্স ফিউশন করে। তবে ব্যান্ডগুলো যে শৈলীই অনুসরণ করুক না কেন ভক্তরা সেখান থেকে নতুন কিছু পান। কে-পপ ব্যান্ডে কমপক্ষে তিন জন থেকে শুরু করে ২৩ জন সদস্য আছেন। কিছু ব্যান্ডের সদস্য শুধু ছেলে, আবার কিছু ব্যান্ডের শুধু মেয়ে। ছেলে-মেয়ে মিলিয়েও ব্যান্ড আছে। মূলত এটি একটি দ্রুতগতির শিল্প। যেখানে শিল্পীরা প্রায়ই প্রতি তিন থেকে পাঁচ মাসে একটি অ্যালবাম বের করেন।

২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সংগীতের এই মাধ্যমটি বিশ্বব্যাপী ছাপ ফেলতে শুরু করে। তখন কিছু গান কোরিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের অন্যান্য অংশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে গার্লস ব্যান্ড ওয়ান্ডার গার্লসের হিট ‘নো বডি’ বিলবোর্ড হট ১০০-এ প্রথম কে-পপ গান ছিল। এক বছর পর মার্কিন শিল্পী লিল কিমের সঙ্গে কে-পপ একক সেভেন বের হয়। তবে সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় কে-পপ ব্রেকআউট ছিল ২০১২ সালে সাই’র আন্তর্জাতিক হিট ‘গ্যাংনাম স্টাইল’। যে গানটিতে দেখে সারা বিশ্বের কে-পপ ভক্তরা নেচেছিল। এটি প্রমাণ করেছিল, আন্তর্জাতিক কে-পপ মিউজিক হিটের জন্য ইংরেজি গানের প্রয়োজন হয় না।

এরপর বিটিএস পপকে কোরিয়ান তরঙ্গে পরিণত করে। তাদের হাত ধরে সারা বিশ্বে কোরিয়ান তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএস। শুধু তাই নয় সাত সদস্যের এই ব্যান্ডের আছে অতিনিবেদিত ফ্যাসবেস বিটিএস আর্মি। বিটিএস শুধু মার্কিন গণমাধ্যমে ঝড় তুলেছে তাই নয়, তারা হোয়াইট হাউসে কূটনৈতিক সফর করেছে এবং জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বাইরে বিটিএসের জনপ্রিয়তার কারণে কে-বিউটি, কে-ড্রামাসহ কোরিয়ান সবকিছুতে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ বেড়েছে। 

সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে কে-পপের যে তরঙ্গ শুরু হয়েছিল তা কিন্তু কমেনি, বরং ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছেই।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //