অবসর-সুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ৬২ হাজার বেসরকারি শিক্ষক

অবসরগ্রহণের পরপরই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসর ও কল্যাণ ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। বরং কিছু শিক্ষকের অবসরগ্রহণের পর মৃত্যু হলেও এই ভাতা পাচ্ছেন না।

জানা যায়, এই খাত থেকে শিক্ষকরা যে অর্থ পান, তার বড় অংশই তাদের বেতন থেকে জমা রাখা হয়। এখন সেই অর্থ পেতেও কমপক্ষে আড়াই বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দেড় বছরের আগে কল্যাণ সুবিধার টাকা পাওয়ার আশাই তারা করতে পারছেন না। এই টাকা পাওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট কার্যালয়ে নিত্যদিন ধরনা দিতে হচ্ছে।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কারও সময়মতো অবসরভাতার সুবিধা পাওয়ার রেকর্ডও নেই। অবসরের টাকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা, রংপুর ও বরিশালের কয়েকজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে তারা মারা গেছেন। 

জানা গেছে সারাদেশে একাধিক শিক্ষক ক্যান্সারে ভুগছেন। টাকার অভাবে তারা চিকিৎসা চালাতে পারছেন না। আ হ ম শফীউল্লাহ হাজারী নামে এক শিক্ষক বলেন, “আমি কষ্টে আছি এবং আমার চিকিৎসা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি গত ৩৫ বছর ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন অসহায়, চরম কষ্টে সময় পার করছি।”

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, “অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দুর্ভোগের বিষয়টি সত্য। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেব।”

অবসর ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ মাসে সরকারি অনুদান) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরের পর দুই ধরনের সুবিধা পান।  

একটি অবসর সুবিধা, আরেকটি কল্যাণ সুবিধা। নিয়মানুযায়ী বয়স ৬০ বছর অথবা চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরে যান। তবে কেউ মারা গেলে তার পরিবার নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। আবার অন্তত ১০ বছর পূর্ণ করে স্বেচ্ছায় অবসরে গেলে জমার টাকা সুদসহ পাওয়া যায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ৩২ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষক অবসরে যান। আর মাসে অবসর ও কল্যাণ ভাতার জন্য প্রায় ৮০০ আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু একজন শিক্ষক মাসে ১০ শতাংশ হিসেবে এই তহবিলে যে টাকা জমা দেন, তা দিয়ে পাওনাদার অর্ধেক শিক্ষককে টাকা দেওয়া যায়। বাকি অর্ধেক টাকা সরকার নিয়মিতভাবে না দেওয়ায় জমা পড়া আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে জমে রয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার আবেদন। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে আবেদনকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন পাওনা টাকার জন্য ঘুরছেন। আর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে জমে আছে প্রায় ২৪ হাজার আবেদন। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৬২ হাজার আবেদনের স্তূপ জমে আছে।

প্রতি মাসে অবসরে যাওয়া প্রায় ৮০০ শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধার জন্য প্রায় ৯০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। প্রতি মাসে ৬ শতাংশ জমাকৃত টাকা থেকে আসে ৬৫ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি থাকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সেই হিসেবে প্রতিবছর জমাকৃত ৯ হাজার ৬০০ আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা। শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা জমা হয় ৬৮০ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি থেকে যায় ৩০০ কোটি টাকা। বর্তমানে যে ৩৮ হাজার আবেদন জমে রয়েছে, তা দিতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রয়োজন।

অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীরা কল্যাণ ট্রাস্টে প্রতি মাসে মূল বেতনের ৪ শতাংশ অর্থ জমা দেয়। কিন্তু এরপরও সেখানে প্রায় ২৪ হাজার আবেদন জমা রয়েছে। যা পরিশোধে এককালীন দুই হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রয়োজন। কবে টাকা পাবেন সেই খোঁজ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষকরা এসে ভিড় করেন ব্যানবেইস ভবনে। ফলে বেসরকারি শিক্ষকদের দুর্দশা কোনোভাবেই কমছে না।

অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমেদ সাদী বলেন, “অবসর বোর্ডের জন্য সরকার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়নি। আসলে এটি আমাদের জন্যও খুব বেদনাদায়ক, যখন একজন শিক্ষক আমার কাছে এসে কাঁদেন। আমরা সময়মতো শিক্ষকদের অবসর সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি, কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।  সরকার আমাকে তহবিল না দিলে আমি কিছুই করতে পারব না,” যোগ করেন তিনি।

অবসর সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তা মারুফ হোসেন জানান, “অবসরকালীন সুবিধার চেক প্রক্রিয়া হতে সময় লাগার কথা প্রায় তিন মাস। দুর্ভাগ্যবশত এখন এতে সময় লাগে প্রায় তিন বছর।” 

সূত্র জানায়, বর্তমানে অবসর সুবিধা বোর্ডে সিড মানি হিসেবে ৬৬০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। যেই টাকায় হাত দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে এর লভ্যাংশ অবসর সুবিধার কাজে ব্যবহার করতে পারেন। আগামী অর্থবছরেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবসর বোর্ডের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। তবে এর বেশিরভাগই সিড মানি হিসেবে দেওয়া হবে। ফলে সেই টাকা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করা যাবে না।

কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, “আমরা প্রতি মাসে শিক্ষকদের চাঁদা বাবদ ৪০ থেকে ৪২ কোটি টাকা পাই। তবে আমাদের প্রয়োজন হয় ৫২ থেকে ৫৪ কোটি টাকা। প্রতিবছর ১২০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা ঘাটতি থেকে যায়। আমরা আগামী অর্থবছরে কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছি। সেটা পেলে অনেক শিক্ষকের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হবে।”

জানা যায়, সরকার আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন চালু করছে। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেহেতু আগে থেকেই পেনশন পান, তাই তারা এর আওতায় আসবেন না। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কিন্তু পেনশন পান না। তারা চাকরি শেষে এককালীন অবসর ও কল্যাণের টাকা পান। 

বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার বলেন, “এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসরকালীন সুবিধার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। অনেক শিক্ষকই অবসরের পর টাকা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনকি ৩০ বছর ধরে নিজের দেওয়া টাকাটাও তাকে যথাসময়ে দেওয়া হয় না। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, এনসিটিবিসহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে অলস হাজার হাজার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। সরকার সেখান থেকেও টাকা এনে শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণের টাকা পরিশোধের উদ্যোগ নিতে পারে।”

অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক বলেন, অবসরের সুবিধা পেতে তাকে মাত্র ৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং সেজন্য তিনি ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিক্ষকরা সময়মতো তাদের সুবিধা পান না এবং বিনা চিকিৎসায় মারা যান, এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক। এ ধরনের ঘটনা বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহীদের নিরুৎসাহিত করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //