শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ চান ডিসিরা

বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের রাজনীতির বাইরে রাখার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। এ জন্য সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার মতো পৃথক সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়। চলমান ডিসি সম্মেলন সামনে রেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়।

প্রস্তাবটি নিয়ে ২৪ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে ডিসিদের আলোচনা হয়। ডিসিদের সেই প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সেশন শেষে তিনি বলেন, ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য আচরণ বিধিমালা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ডিসিরা। এটি ভালো প্রস্তাব। শিক্ষকদের জন্য শিগগিরই আলাদা আচরণ বিধিমালা করা হবে।’ 

বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধে প্রস্তাব

এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা এখন মূল বেতনের পুরোটা সরকার থেকে পান। এর সঙ্গে সামান্য কিছু ভাতা দেওয়া হয় তাদের। তবে বেসরকারি হওয়ায় তারা সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ পান। এই সুযোগ বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করছেন জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি)। তাই সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যও সুনির্দিষ্ট বিধিমালা করার প্রস্তাব এসেছে ডিসিদের পক্ষ থেকে।

বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধে ডিসিদের প্রস্তাবকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের শামিল’ বলছেন বেসরকারি শিক্ষকনেতারা। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব শাহজাহান আলম বলেন, বাংলাদেশ ইউনেসকো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইলএলও) সদস্য রাষ্ট্র। সে অনুযায়ী, শিক্ষকেরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে এবং দেশ গঠনে ভ‚মিকা নিতে পারবেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সরকারকে আগে ইউনেসকো ও আইএলওর সদস্যপদ ছাড়তে হবে। তাই ডিসিরা যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা অযৌক্তিক। এটা শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হনন করারই শামিল। 

বেসরকারি শিক্ষকদের সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতা শাহজাহান আলম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন তিনি। তবে পরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নির্দেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।

ইউএনওদের শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব

বর্তমানে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটিতে চেয়ারম্যান হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানেরা। ইউএনওরা নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান। উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষা কমিটিতে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। শরীয়তপুরের ডিসি মো. পারভেজ হাসান শিক্ষা কমিটিতে ইউএনওদের চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন, ইউএনওরা চেয়ারম্যান হলে উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিদ্যালয় পরিদর্শন ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে বলেও তার এই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। 

তবে বর্তমানে অনেক উপজেলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ইউএনওদের একধরনের দূরত্ব আছে। এখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত হলে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব যেমন বাড়বে, তেমনি জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাও খর্ব হবে বলে মনে করেন অনেকেই। 

পোষ্য কোটা বাতিলের প্রস্তাব

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে পোষ্য কোটা বাতিলের প্রস্তাব করেছেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক। এর সপক্ষে যুক্তিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পোষ্য কোটা থাকায় অধিকতর যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্তে¡ও অনেক দুর্বল প্রার্থী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই পরিবারে চাকরিজীবীর সংখ্যা বেড়ে যায়। দরিদ্র পরিবার বা মেধাবী প্রার্থী বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সরকারের নীতি প্রতি পরিবারে চাকরি, এ উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। এর মাধ্যমে দেশে ৪৬ বছর ধরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যে কোটাব্যবস্থা ছিল, তা বাতিল হয়ে যায়।

কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে এখনো কোটাব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা এবং রেলের নিম্নপদস্থ চাকরিগুলোয় ৪০ শতাংশ পোষ্যদের জন্য সংরক্ষিত। 

গত ১৪ ডিসেম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে ৩৭ হাজার ৫৭৪ প্রার্থীকে নির্বাচিত করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। এতে ২০ শতাংশ প্রার্থী পোষ্য কোটায় নিয়োগ পান। এরপর প্রাথমিকে কোটা বাতিলের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় নিয়োগ হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অথচ এখানে ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা রাখা হয়েছে। পোষ্য কোটার কারণে আমার মতো সাধারণ প্রার্থীরা ভালো পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পান না। এই বৈষম্যমূলক পোষ্য কোটা দ্রুত বাতিল করা হোক।’ 

অবসরজনিত শূন্য পদে সংযুক্তি প্রদানের সুপারিশ 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরজনিত শূন্য পদে সংযুক্তি প্রদানের সুপারিশ করেছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক। এই প্রস্তাবের সপক্ষে যুক্তিতে বলা হয়েছে, অবসরের কারণে অনেক সময় শিক্ষক সংখ্যা তিনের কম হয়ে যায়। দুই শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়ে কমপক্ষে তিনজন ও এক শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়ে ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। অবসরজনিত শূন্য পদে সংযুক্তি প্রদানের সুযোগ না থাকায় কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে পাঠদান কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। 

আরও কিছু প্রস্তাব

জেলা প্রাথমিক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর শূন্য পদ পূরণের প্রস্তাব করেছেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক। এই প্রস্তাবের সপক্ষে যুক্তিতে বলা হয়েছে, নেত্রকোনা জেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অনুমোদিত পদ সংখ্যা ৪৬টি, এর মধ্যে ২৫টি শূন্য পদ রয়েছে। কর্মচারীর অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৫৮টি, এর মধ্যে শূন্য পদ ২৭টি। গত ১০ বছরে নেত্রকোনা জেলার শূন্য পদের পরিস্থিতি একই রকম। ফলে বিদ্যালয় পরিদর্শন ও দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে বিঘ্ন ঘটছে।

সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নতুন পদ সৃষ্টি ও শূন্য পদ পূরণের প্রস্তাব করেছেন লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক। তিনি যুক্তি দেখান, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অনেক পদ শূন্য রয়েছে। 

নওগাঁর জেলা প্রশাসক প্রস্তাব করেছেন, স্বল্প শিক্ষার্থীবিশিষ্ট বিদ্যালয় বিলুপ্ত করে পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভ‚ত করতে হবে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের যৌক্তিক অনুপাত বজায় থাকবে, যার ফলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন তিনি। 

নরসিংদী জেলার চরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মিড-ডে মিল চালুর প্রস্তাব করেছেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক। তার প্রস্তাবের সপক্ষে যুক্তিতে বলেছেন, চরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তাদের শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতাও কম। তাই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে আগ্রহ কম। মিড- ডে মিল চালু হলে অনেক পিতামাতার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার পাশাপাশি শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //