নওগাঁর পুকুর আর রাজার ভালোবাসার কিংবদন্তি

ভালোবাসার স্বাক্ষর কিংবা ধর্মীয় কোনো সংকল্পের স্মৃতিচিহ্ন ইতিহাসের পাতায় আঁকতে ভূরি ভূরি সম্পদ ব্যয় করেছেন রাজা-বাদশাহরা। উপমহাদেশের পরতে পরতে মিশে আছে সেসবের কিংবদন্তি। তেমনই এক ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নের সাক্ষী নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চক-চান্দিরা গ্রাম। এ গ্রামে ৩৬৫টি পুকুর, একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে রয়েছে। আর এই পুকুরগুলোকে নিয়েই রয়েছে অদ্ভুত এক কিংবদন্তি।

লোকমুখে প্রচলিত স্থানীয় গল্পটি হলো, চান্দিলাল পাল নামের এক রাজা বহুকাল আগে এ গ্রাম থেকে রাজ্য পরিচালনা করতেন। প্রথম রানিকে বিয়ে করে প্রাসাদে নিয়ে আসার কয়েক বছর পর আরেক নারীর প্রেমে পড়েন। সে নারীকেও বিয়ে করে দ্বিতীয় রানির মর্যাদায় প্রাসাদে নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় রানিকে রাজা প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। বিয়ের কিছুদিন পর রানি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।

রাজা চান্দিলাল রাজ্যের সকল কবিরাজ-হেকিমকে ডেকে পাঠান। কিন্তু তারা রানিকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হলেন। এরপর পাশের রাজ্যে এক দক্ষ হাকিমের খোঁজ পান রাজা। তিনি দূত মারফত হেকিমকে নিজ রাজ্যে আসার আমন্ত্রণ জানান। হেকিম আসার পর রানির রোগ সম্পর্কে সব খুলে বলেন রাজা। সব শুনে হেকিম রাজাকে বলেন, ৩৬৫টি পুকুর খনন করে রানিকে প্রতিদিন একটি করে পুকুরে যদি গোসল করানো হয়, তাহলে রানি এ দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করবেন। হেকিমের কথায় রাজা খানিকটা চিন্তায় পড়ে যান। এত অল্প সময়ে কীভাবে এতগুলো পুকুর তিনি খনন করাবেন! কিন্তু দ্বিতীয় রানিকে যে রাজা খুব ভালোবাসতেন, তার জন্য এই অসাধ্য সাধনে রাজ্যের সব প্রজাকে নামিয়ে দিলেন পুকুর খননের কাজে। দিনে একটি পুকুর খনন করা শেষ হয় আর রানি সেখানে গোসল করেন। এভাবে এক বছরে ৩৬৫টি পুকুরে গোসল করার পর রানি দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পান।

রাজা চান্দিলাল পাল ঠিক কবে এ অঞ্চল শাসন করেছেন এবং কতটুকুই বা তার রাজ্যের আয়তন ছিল, এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানা যায় না। ইতিহাস গবেষকরা এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো মতামত প্রদান করতে পারেননি। তবে রাজা চান্দিলাল পাল অষ্টম খ্রিষ্টাব্দের পাল শাসনামলের সামন্ত রাজা হতে পারেন বলে তারা ধারণা পোষণ করেন। ইতিহাস গবেষক হাসেম সূফী জানালেন, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং মুসলমান শাসনামলের পুকুর বা দিঘিগুলো একটি আরেকটির থেকে আকার-আকৃতিতে ভিন্ন হয়। প্রতিটি শাসনামলে নির্দিষ্ট একটি আকৃতিতে পুকুর ও দিঘি খনন করা হয়েছে। যেমন-বৌদ্ধ শাসনামলে খনন করা জলাশয়গুলো দৈর্ঘ্যে বড় হয়, হিন্দু শাসনামলের জলাশয়গুলো আকারে একটু ছোট হয় এবং মুসলিম শাসনামলের মধ্যে পাঠান আমলের জলাশয়গুলো দৈর্ঘ্যে বড় হয় আর মুঘল আমলের জলাশয়গুলো বর্গাকৃতিতে বড় হয়ে থাকে। 

নওগাঁর এই পুকুরগুলো কোন পাল রাজার আমলে খনন করা হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বর্তমানে এই ৩৬৫টি পুকুরের প্রতিটির পাড়ে রয়েছে বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্প। যার আয়তন ২২০ একর। আর পুকুরগুলো সরকারিভাবে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। রাজা চান্দিলাল পাল ও তার দ্বিতীয় রানিকে ঘিরে যে ভালোবাসার গল্প ঘুরে বেড়ায় চক-চান্দিরা গ্রামের আকাশে-বাতাসে, তার ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি যদি না-ও পাওয়া যায়, তবু ৩৬৫টি পুকুর নিয়ে রাজা ও রানির ভালোবাসার এ গল্প লোকমুখে ফিরবে যুগের পর যুগ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //