খাপড়া ওয়ার্ড: দেশের ইতিহাসে প্রথম জেলহত্যা

ভারতবর্ষ ভেঙে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। এ রাষ্ট্র নিয়ে যারা স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, অল্প কিছু দিনের মধ্যে তাদের সে স্বপ্নে ছেদ ঘটতে থাকে। সৃষ্টি হলো ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলন যখন তীব্র হতে থাকে, রাজশাহী কারাগারে সৃষ্টি হলো রক্তের এক ইতিহাস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দি শিবিরে নির্যাতন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শোনা যায়। বিভিন্ন মাধ্যমে তা জানতে পাওয়া গেলেও নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের রাজশাহী জেলা সদরের কারাগারে ১৯৫০ সালে যে নির্যাতন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা কেবল গুটিকয়েক ব্যক্তি আর মুক্ত চিন্তার কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। 

১৯৪৯ সালের মার্চ মাস। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে রাজবন্দিদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বিল করা হলে প্রতিবাদে রাজবন্দিরা সোচ্চার হন। ভারতবর্ষ খণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও ব্রিটিশ আইনকানুনের প্রভাব তখনো ছিল। রাজশাহী জেলা কারাগারে একটি মাটির টালির ছাউনির ওয়ার্ড ছিল। এই ওয়ার্ডটিই খাপড়া ওয়ার্ড নামে পরিচিত। এখানে সে সময় বন্দি রাখা হয় কমিউনিস্ট, বামপন্থি, মুক্ত চিন্তার প্রগতিশীল রাজবন্দিদের। তাদের কেউ ছিলেন রাজনীতিবিদ, সংগঠক, শ্রমিকনেতা কেউ ছাত্রনেতা। সে সময় বন্দিদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া হতো। দেওয়া হতো নিম্নমানের খাবার। এর প্রতিবাদে বন্দিরা প্রতিবাদ জানিয়ে হয়ে যান ঐক্যবদ্ধ। তারা রাজবন্দিদের ডিভিশন ও নির্যাতন বন্ধের দাবি জানান, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এতে ভ্রুক্ষেপ না করলে প্রতিবাদ তীব্র হয়। বন্দিরা অনশন শুরু করলে তাদের জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টাটি ব্যর্থ হয়। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল কারাগারপ্রধান বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার নামে কয়েকজনকে নিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডে গেলে সেখানকার এক বন্দির সঙ্গে তার বিবাদ শুরু হয়। বন্দিটিকে তিনি প্রহার করতে গেলে পরিস্থিতি অন্য রূপ ধারণ করে। পুরো কারাগার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বন্দিদের নামে অভিযোগ প্রচারে কৌশলে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে জানালা দিয়ে গুলি করে রাজশাহী ও রংপুরের রেল শ্রমিক বিজলী ধার, সুধীর ধার, দিনাজপুরের কম্পরাম সিংহ, কুষ্টিয়ার মোহনী দিনের হানিফ শেখ, ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের (সম্মান) ছাত্র সুখেন্দ ভট্টাচার্য, খুলনার দৌলতপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফেডারেশনের আনোয়ার হোসেন, লাল ঝাণ্ডা নেতা দেলোওয়ার হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আহত হন বত্রিশ বন্দি। বাম রাজনীতিবিদ, শ্রমিকনেতা, ছাত্রনেতা ও বিদ্রোহী কমরেডদের রক্তে রঞ্জিত হয় খাপড়া ওয়ার্ড। তাদের সেদিনের আত্মত্যাগের রক্তে গড়া ইতিহাস অন্যান্য কথার ফুলঝুরিতে ধামাচাপা পড়ে যায়।