নোনা মাটিতে কৃষি বিপ্লব

নালায় মাছ, মাচায় হরেক রকমের সবজি, পুকুর জুড়ে হাঁসের পাল, উঠানে গবাদিপশু-এ যেন সবুজে মোড়ানো গ্রাম। একচিলতে জমিও অনাবাদি নেই। অথচ মাত্র এক দশক আগে নোয়াখালীর চরাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে চাষাবাদ হতো না বললেই চলে।

নোনা মাটির ওই সব চরেই এখন যতদূর চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। সর্বত্রই সবজি চাষ হচ্ছে। তবে এখানকার চাষাবাদের পদ্ধতি দেশের অন্য সব এলাকা থেকে আলাদা। একই সঙ্গে জলাশয়ে হচ্ছে মাছ চাষ, পানিতে সাঁতার কাটছে হাঁস। তার পাড়ে কখনো শিম, শসা, আবার বরবটি, করলা, লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, পটোলের চাষ হচ্ছে। বাড়ির পাশের জলাশয়ের পানির ওপর গড়া মাচায় লতানো সবজি চাষাবাদের এই পদ্ধতির নাম ‘সর্জন’।

নোয়াখালীর উপকূলীয় সুবর্ণচর উপজেলার আটটি ইউনিয়নের তিনটি চরবাটা, পূর্ব চরবাটা, মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন বছর দশেক আগেও ছিল বনদস্যু-অধ্যুষিত এলাকা। ইউনিয়নগুলোর অনেক অঞ্চল আসলে কয়েক দশক ধরে নদী থেকে জেগে ওঠা চর। নদী সিকস্তিতে ঘরবাড়ি হারানো লোকজন এসে এখানে বসত গড়েছিল বনদস্যুদের আনুকূল্যে। দস্যুদের হয়ে প্রথমে অনেকেই চরের বনভূমি উজাড়ে অংশ নেন, তারপর দস্যুদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কেনা জমিতে বসত গড়েন। এখন অবশ্য চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্পের (সিডিএসপি) মাধ্যমে তাদের অনেকেই জমি ভোগদখলের মালিকানা পেয়েছেন। চরের জমিতে বসত গড়ার জন্য প্রথমে নিচু জমিকে উঁচু করে নিতে হয়েছে এবং এ কারণে প্রত্যেকেই বাড়ির পাশের জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করেছেন। অবশ্য লবণপানির ওই এলাকায় বসবাসের জন্য পুকুর খনন করাও জরুরি ছিল। সেসব পুকুরকে ঘিরেই এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘সর্জন’, যা চরের কৃষিতে বিপ্লব এনেছে।

প্রথমে পুকুরপাড়টি বেশ উঁচু করা হয় এবং পাড়ে বোনা হয় লতানো সবজির বীজ। মূলত শীতকালে বেশি চাষাবাদ হলেও উঁচু পাড়ের কারণে বর্ষায় লোনাপানি এলেও চাষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আবার শীতে পুকুরের পানি চাষাবাদে ব্যবহৃত হয়। পুকুরের মাছ বাড়তি আয়ের উৎস হয়। প্রায় সবার বাড়িতেই রয়েছে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগির ছোট ছোট খামার।

বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতার কারণে সুবর্ণচর উপজেলায় হাজার হাজার হেক্টর ভূমি অনাবাদি পড়ে থাকত। কিন্তু এখন আর তা হয় না। সর্জন পদ্ধতির সুবাদে এক চিলতে জমিও আর অনাবাদি থাকে না। এ পদ্ধতিতে বছরজুড়ে মাছ ও সবজি একসঙ্গে চাষ করে লাভবান হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষক।

উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের চর মজিদ এলাকায় গিয়ে কথা হয় শফিউল ইসলাম নামের এক কৃষকের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথমে ২ একর অনাবাদি জমি দিয়ে তিনি এ চাষাবাদ শুরু করেন। মাটি কেটে নালা করে সেখানে মাছ, সেই নালার পাড়ে মাচায় সবজি এবং বাকি খালি জায়গায় গরু-ছাগল পালন করছেন। শফিউল জানান, তার এ প্রকল্প থেকে প্রতিবছর লাখ টাকার মতো আয় হয়; যা দিয়ে ভালোভাবেই তার সংসার চলে যায়। 

শুধু শফিউল নন, এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে এ গ্রামে সফল হয়েছেন সখিনা খাতুন, মজিদ মিয়া, সেলিম হোসেনসহ আরও অনেকেই। 

সফল চাষি মজিদ মিয়া জানান, এ পদ্ধতিতে সবজি ও মাছ উভয় একসঙ্গে সারা বছর চাষ করে লাভবান হচ্ছেন তিনি। 

এ পদ্ধতি নিয়ে কথা হয় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্মকর্তা হারুন অর রশিদের সঙ্গে। তিনি জানান, পদ্ধতিটি অবলম্বন করে সুবর্ণচরের শত শত কৃষক তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম কিছু কৃষক এ চাষাবাদ শুরু করেন। এখন তা পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। 

তিনি বলেন, ‘সর্জন’ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার একজন ব্যক্তির নাম। তিনি প্রথম তার দেশে এ পদ্ধতিতে চাষ শুরু করে সফল হন, তাই তার নামানুসারে এ চাষপদ্ধতির নাম হয় ‘সর্জন পদ্ধতি’। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে।

কৃষির এ পদ্ধতি অবলম্বন করেই নদীভাঙনের শিকার মানুষ এসে বসত গড়ে তুলছেন নোনা পানির সাম্রাজ্যে। সুবর্ণচরের মতো এ পদ্ধতিটি যদি উপকূলের অন্য এলাকাতেও প্রয়োগ করা হয়, তাহলে কৃষিতে ঘটবে বিপ্লব। ভাগ্য ফিরবে চরের কৃষকদের। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //