ঐতিহ্য অহঙ্কারের জব্বারের বলী খেলা

বলী খেলা, এক বিশেষ ধরনের কুস্তি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি ‘বলী খেলা’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতিবছর ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলী খেলা। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলী খেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশপাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।

ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলী খেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়া ও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামি-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।

চট্টগ্রামের মুরব্বিদের ভাষ্য, কর্ণফুলী ও শঙ্খনদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরত প্রদর্শন। এই মল্ল বীরেরাই ছিলেন বলী খেলার প্রধান আকর্ষণ ও মূল প্রেরণা। কিন্তু এখন পেশাদার বলীর (কুস্তিগির) অভাবে আকর্ষণ অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পেশাদার বলী পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এখন আর কেউ বলী কিংবা কুস্তি খেলতে আগ্রহ দেখায় না। আগে গ্রামে গ্রামে কুস্তি আর বলী খেলা হতো। আজ সেই দৃশ্য প্রায় কল্পনার পর্যায়ে চলে গেছে। 

মাঝখানে দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ করোনার কারণে এই বলী খেলা বন্ধ ছিল। একে কেন্দ্র করে যে মেলা গড়ে ওঠে সেটাও বন্ধ ছিল দুবছর। এরপর অবশ্য আবারও নিয়মিত হয়। চলতি বছর জব্বারের বলী খেলার ১১৫তম আসর অনুষ্ঠিত হবে। 

বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে মানুষ ছুটে আসে এই বলী খেলা দেখতে। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার বাঁচিয়ে রাখার জন্য মেলাটিও চমৎকার একটি উদাহরণ। তাই অনেকে বলী খেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেও চেনে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের আশপাশের এলাকা ঘিরে।

জব্বারের বলী খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলী খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলী খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলী খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী খেলা, নগরীর সিআরবিতে সাহাবুদ্দিনের বলী খেলা বিদ্যমান। তবে জব্বারের বলী খেলা বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’তে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। 

জব্বারের বলী খেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী ও রানার্সআপ রামুর জীবন বলী। জব্বারের বলী খেলায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী। তিনি সর্বোচ্চ ১৩ বার বিজয়ী হয়েছেন। বর্তমানে দিদার বলী এ খেলা থেকে অবসরে আছেন। 

যদিও এই বলী খেলার আয়োজন নিয়ে আছে নানা মত। অনেকেই জানান, যাকে তাকে সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত বলীদের খেলায় সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে এ খেলার মান এবং দর্শক দুটোই বেঁচে থাকবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //