পানি সঙ্কটে চুয়াডাঙ্গার মানুষ

চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪টি উপজেলায় ভূগর্ভস্থে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েল এবং গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উঠছে না। এ কারণে পানির সঙ্কটে রয়েছে জেলাবাসী। পানি পেতে ১০ থেকে ১২ ফুট গর্ত তৈরি করে ওই গর্তের ভেতরের অংশের নিচে বৈদ্যুতিক মোটর নামিয়ে তারপর মোটর চালিয়ে পানি সংগ্রহ করছেন কেউ কেউ। পানি সঙ্কটে নিদারুণ কষ্ট পোহাচ্ছে গ্রামীণ জনপদের মানুষ। ধান কেটে এনে চাল প্রস্তুতের জন্য ধান সিদ্ধ করার জন্য যে পানি প্রয়োজন তা তারা পাচ্ছেন না।

চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪ মাস ধরে পানির সঙ্কট তৈরি হলেও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বা জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন থেকে এটার প্রতিকারের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত অপব্যবহারের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানাচ্ছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা। 

সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রাম কোমরপুর, বাঘাডাঙ্গা, আরামডাঙ্গা, কাঞ্চনতলা, সুবলপুর, পীরপুরকুল্লা, কানাইডাঙ্গা, বয়রা, হুদাপাড়া, মুন্সীপুর, কুতুবপুর, হরিরামপুর ও শিবনগর।

কুড়ুলগাছী ইউনিয়নের চাকুলিয়া, দুর্গাপুর, সদাবরি, বুঁইচিতলা, ঠাকুরপুর, ফুলবাড়ী, ধান্যঘরা, হরিশচন্দ্রপুর, নতুন গ্রাম, চন্ডিপুর ও প্রতাপপুর।

পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের সব কয়টি গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বহু নলকূপে একেবারেই পানি উঠছে না। কিছু কিছু নলকূপে কম পানি উঠছে। অনেকের নলকূপের পানি কম ওঠায় ওই নলকূপ সরিয়ে নতুন স্থানে বসিয়েও লাভ হচ্ছে না। সেখান থেকেও পানি উঠছে না।

দামুড়হুদা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দাপ্তরিক সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় সরকারী সাড়ে ৫ হাজার ও ব্যক্তি মালিকানা মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এলাকার নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। নলকূপে পানি না উঠলেও আবার পানির চাহিদা মেটাতে গভীর নলকূপ বসানোর দিকেই ঝুঁকছেন অনেকে। পানির চাহিদা পূরণ করতে ১০-১২ ফুট গর্ত খুঁড়ে মাটির রিঙ স্লাব বসিয়ে পানি তোলার মোটর নিচে নামিয়ে পানি ওঠানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। 

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা শহরের দশমিপাড়ার বাসিন্দা সাংবাদিক হাবিবুর রহমান হবি বলেন, এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর নেমে যাওয়াতে অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি ওঠা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু টিউবওয়েলে সামান্য পরিমাণ পানি উঠলেও শরীরের অধিক পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সীমান্তবর্তী কুতুবপুর, মুন্সীপুর,কানাইডাঙ্গা ও কুড়ুলগাছী অঞ্চলে। দামুড়হুদা উপজেলা শহরের দশমী পাড়ার ঘরে ঘরে প্রায় একই অবস্থা। ১২-১৩ ফুট গর্ত খুঁড়ে মটর নামিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। আমার নিজেরও দুটি মোটর ছিল। পানি না ওঠায় মোটরের ওপর চাপ পড়াই একটি মোটর পুড়ে গেছে। 

একই পাড়ার বাসিন্দা দামুড়হুদা সদর ইউনিয়নের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য শাহনাজ পারভীন জানান, অনেক দিন ধরে আমাদের টিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। ১০-১২ ফুট গর্ত করে সেখানে মোটর বসিয়ে সেখান থেকে পানি তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু পানি উঠছে না। কিছু বাড়িতে এমন হয়েছে। তারা এভাবেই পানি তোলার চেষ্টা করছে।

কুড়ুলগাছী গ্রামের বাসিন্দা নূরুল বলেন, আমাদের কলে ২০ দিন থেকে পানি উঠছে না। পানি সঙ্কটের কারণে পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। পানির এত সঙ্কট কল চেপে চেপে সামান্য পানিও উঠছে না। কোনোভাবেই পানির সমস্যা মেটাতে পারছি না। 

একই গ্রামে আলম জানান, তাপের কারণে পানির খুব সঙ্কট। আমাদের খুব দুর্যোগ। আজ দেড় মাস ধরে আমাদের কলে পানি নেই। পরের বাড়ি থেকে পানি এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

আরামডাঙ্গা গ্রামের সাগরিকা বলেন, দেড় মাস ধরে কলে পানি উঠছে না। গরমে অন্য জায়গা থেকে পানি আনতে হচ্ছে। পরের বাড়ি ও পুকুর থেকে পানি এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। ধান কাটা হয়ে গেছে। না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। কারণ ধান সিদ্ধ করে চাল তৈরি করবো তা পানির জন্য হচ্ছে না।

একই কথা বলেন চন্ডিপুর গ্রামের আক্তারুল। তিনি বলেন,আমাদের টিউবওয়েল দিয়ে দেড় মাস ধরে পানি উঠছেনা। ধান কেটে গোছাচ্ছি। ধান সিদ্ধ করার পানি পুকুর থেকে আনছি। ওই পানি গরু বাছুরকেও খাওয়াচ্ছি। গরমে গরু গোসল করাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

কার্পাসডাঙ্গা আদিবাসীপাড়ার নমিতা রানী জানান, দেড় মাস ধরে তাদের কল থেকে পানি উঠছে না। পুরোন কলের পাশে আবার নতুন করে কল পোঁতা হলেও সেখান থেকে পানি উঠছে না। অন্যের বাড়ি থেকে পানি এনে ব্যবহার করছেন তারা।

একই পাড়ার বাসিন্দা অর্চনা বলেন, ৩-৪ মাস ধরে তাদের কলে পানি উঠছে না। বরিং (গভীর নলকূপ) থেকে পানি এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। স্নান, খাওয়া অন্যান্য কাজে পানি ব্যবহার না করতে পারায় তারা খুব কষ্ট আছে।

চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদ জানান, উষ্ণতা ও অপরিকল্পিতভাবে পানির অপব্যবহারের ফলে এ অঞ্চলে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১২ হাজারের অধিক নলকুপ ও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গভীর নলকুপ দেওয়া হয়েছে যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। চেষ্টা চালানো হচ্ছে, কিভাবে নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো যায়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা পানি সঙ্কট প্রসঙ্গে বলেন, শুধু চুয়াডাঙ্গা জেলা নয়, আশপাশের কয়েকটি জেলায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানি সঙ্কট দুর করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যক্রম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

প্রতিবছর এ জেলায় ৬ থেকে ৮ ফুট নিচে নামছে পানির স্তর। বছর দশেক আগেও চুয়াডাঙ্গায় ৪০ থেকে ৬০ ফুটের মধ্যে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ছিল। এখন বর্ষা মৌসুমেও ১০০ থেকে ১৪০ ফুটের মধ্যে পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না। অপরিকল্পিতভাবে শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্র পুকুর খোঁড়ার কারণে খালবিল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট মত প্রকাশ করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //