বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ

পাহাড়ে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল, ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কুসংস্কার

সাম্প্রতিক সময়ে রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের দুর্গম চান্দবীঘাট পাড়ায় বাবা-মেয়েসহ ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘অজ্ঞাত রোগে’ মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড়ে। স্থানীয়রা গ্রামের একটি পুরাতন গাছ কাটার ফলে ভূতে ভর করেছে বলে ধারণা করেছিল। কাকতালীয়ভাবে গাছ কাটার পরবর্তী সময়ে তিন মাস সময়ের মধ্যেই গ্রামের পাঁচজন মানুষের মৃত্যুকে ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অজ্ঞাত রোগে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ মারা যাচ্ছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর স্বাস্থ্য বিভাগের একটি চিকিৎসক দল যায় সেই চান্দবীঘাটে। 

রোগের লক্ষণ দেখে জানা যায়, পাঁচজনেরই মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিক রোগে। অথচ ভূতে ভর করার গুজবে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো গ্রামে। সরকারি চিকিৎসা সেবার আওতার বাহিরে থাকা গ্রামের মানুষ ছুটে গিয়েছিল স্থানীয় বৈদ্য-কবিরাজের কাছেই।

ওই সময় চান্দবীঘাট পাড়া থেকে ফিরে এসে মেডিকেল টিমের প্রধান বরকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মংক্যছিং মারমা সাগর জানিয়েছিলেন, যারা মারা গিয়েছেন তারা স্বাভাবিক রোগেই মারা গেছেন। তাদের কারো লিভার, কিডনি ও প্যারালাইসিসজনিত জটিলতা ছিল। আর যারা তখন অসুস্থ ছিলেন তারাও সর্দি, কাশি, জ্বর নিয়ে ভুগছিলেন। গ্রামের মানুষ বৈদ্য দিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা করে লতা-পাতা সিদ্ধ করে খাওয়ানোর ফলে তারা এই সমস্যায় পড়েছিল। কবিরাজ অনেককে খেতেও দেননি।

শুধু বরকলের চান্দবীঘাট নয়; রাঙ্গামাটির দুর্গম উপজেলাগুলোয় প্রতি বছরই পানিবাহিত রোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের খবর পাওয়া যায়। বিশেষত আয়তনে জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়ন, জুরাছড়ির দুমদুম্যা ও মৈদং ইউনিয়ন এবং বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের বাসিন্দারা ডায়রিয়াসহ অন্য পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হন স্থানীয়রা। ওইসব এলাকায় সুপেয় পানি সংকট বছর জুড়েই থাকে। গ্রামের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা উপজেলা সদরে এসে চিকিৎসা নিতে না পারায় অসুস্থ হয়েই মারা যান। প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও স্থানীয়রা কুসংস্কারে বিশ্বাসে হওয়ায় অনেকেই সরকারি চিকিৎসা কিংবা টিকা গ্রহণ করতে চান না। কুসংস্কারের ফলে টিকাভীতিসহ নানা কারণেই এসব এলাকার মানুষ চিকিৎসা সেবার বাহিরে রয়েছেন। পাহাড়ে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেগুলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় স্থানীয়রা চিকিৎসা সেবা গ্রহণ থেকে বিরত থেকে যায়। 

জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, প্রতি বছরই রাঙ্গামাটিসহ তিন পাহাড়ি জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত, মশাবাহিতসহ বিভিন্ন রোগে মারা যায়। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরা কুসংস্কারের প্রতি এখনো আকৃষ্ট থাকায় বৈদ্য-কবিরাজ ও গাছগাছালি পূজা করেন। এতে করে সাধারণ রোগে অসুস্থ হয়েও চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা ম্যালেরিয়ার ‘রেড জোন’ বা ‘হট স্পট’ হিসেবে পরিচিত। তবে ২০১৭-২৩ সাল পর্যন্ত রাঙ্গামাটিতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি। কিন্তু রাঙ্গামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর ৯০ শতাংশই পাওয়া যাচ্ছে সীমান্ত এলাকায়। ভারত সীমান্তবর্তী রাঙ্গামাটির চার উপজেলা বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল ও বাঘাইছড়িতে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের মোট রোগীর ৯০ শতাংশই পাওয়া যাচ্ছে। শহুরাঞ্চলে মশার জীবাণু ধ্বংস কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে থাকলেও দুর্গম ও সীমান্তবর্তী এলাকায় এই কার্যক্রম তেমন না থাকায় ও ঘন জঙ্গলের কারণে ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে।

চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির সাজেক ইউনিয়নে শিয়ালদহলুই মৌজায় দুইটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের গোলাগুলিতে রোমিও ত্রিপুরা নামে ৭ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তখন গ্রামের বাসিন্দারা দীর্ঘ ৭-৮ ঘণ্টা বাঁশের সাহায্যে শিশুটিকে কাঁধে বহন করে সাজেকের কংলাকে পৌঁছান। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে চট্টগ্রামে নেওয়া হয় শিশুটিকে। সেই শিশুটি প্রাণে বাঁচলেও সাজেকের মতো প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের মানুষ মারা যাচ্ছেন চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার কারণেই।

পাহাড়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. প্রবীর খিয়াং বলেন, পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্গম এলাকার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে ভুল চিকিৎসা নয়তো কুসংস্কারের কারণে। এখন দেখবেন প্রান্তিক এলাকাগুলোর মানুষ রোগ মুক্তির প্রত্যাশায় নদীর পাড়ে পূজা দেন, বৈদ্য কবিরাজের দ্বারস্থ হন। ভুল চিকিৎসার কারণে পাহাড়ের প্রান্তিক এলাকার মানুষ মারা যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও দেখলাম সাজেকে একটা শিশুকে বাঁশ দিয়ে কাঁধে করে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছানো না গেলে সাধারণত বৈদ্য কবিরাজের কাছেই যাবে। এতে করে চিকিৎসার অভাব ও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু বাড়বেই।

সম্প্রতি রাঙ্গামাটির সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী জানিয়েছেন, রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়ি চান্দবীঘাট পাড়ায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক রোগেই। আমাদের মেডিকেল টিম সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের চিকিৎসা দিয়েছে এবং দেখেছে কবিরাজি চিকিৎসার কারণে অনেকেই নিয়মিত না খেতে পেরেও দুর্বল হয়ে গেছে। গ্রামের গাছ কাটার কারণে ভূত ভর করেছে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। পাহাড়ে এখনো গ্রামের মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাসী। স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতুলতার কারণে সব খানে চিকিৎসা সেবাও পৌঁছানো যায়নি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //