কুষ্টিয়ায় বাড়ছে তামাক চাষ, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও

কুষ্টিয়ার মিরপুর, ভেড়ামারা ও দৌলতপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে। এরফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

পাশাপাশি তামাক চাষে অতিরিক্ত সার কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মাটির উর্বর শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা অন্য ফসল বাদ দিয়ে তামাক চাষ করছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়া জেলায় আবাদযোগ্য জমি রয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর। সেখানে এবার বোরো আবাদ হচ্ছে মাত্র ৩৬ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। অপর দিকে তামাক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি ও আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ৩ হাজার ৬৯৬ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৭৮০ হেক্টর এবং মিরপুরে ৬ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।

চাষিরা জানান, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং বিভিন্ন কোম্পানির দেওয়া প্রণোদনার কারণে তারা তামাক চাষে ঝুঁকছেন।


জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তামাক ক্ষেত। ক্ষেতে কেউ তামাক গাছের পরিচর্যা করছেন, কেউ নষ্ট পাতা কাটছেন। আবার কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তামাক ক্ষেতে সার দিচ্ছেন।

তামাক চাষিরা জানান, তামাক লাগানোর শুরু থেকেই বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা আমাদের সহায়তা করে থাকে। সার-বীজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামগ্রী প্রদান করে এবং ভালো দামেরও নিশ্চয়তা দেয়। তাছাড়া টার্গেটের জন্য আলাদাভাবে কার্ড তৈরি করে দেয়। যার ফলে চাষিরা তামাক চাষে উৎসাহিত হয়। বিক্রিতেও কোনও ঝামেলা হয় না। তবে তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ খাটুনির প্রয়োজন হয় এবং স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হওয়া সত্ত্বে এই তামাক চাষ করে থাকে তারা।

মিরপুর উপজেলার বলিদাপাড়া এলাকার তামাক চাষি জীবন আলী মন্ডল বলেন,  তবে তামাক চাষে লাভ বেশি। প্রতি বিঘা তামাক চাষে  খরচ হয় ৪০-৪৫ হাজার টাকা। তামাক জ্বালিয়ে তা বিক্রি হয়ে থাকে ৮০-৯০ টাকায়। তামাক চাষে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় আমরা এই আবাদ করে থাকি। বিক্রয় শেষে মোটা টাকা পাওয়ায় সেই টাকা দিয়ে ঘরবাড়ী কিংবা জমি ক্রয় কার যায়।

মশান এরাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, তামাক চাষে অতিরিক্ত সার ব্যবহার করার ফলে ভালো ফলন হয়। বিভিন্ন কোম্পানি চাষিদের সহায়তা করে থাকে। আবার বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। অথচ, টমেটো বা সবজির আবাদ বেশি হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিংবা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দাম পাওয়া যায় না। তাই ভালো বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকলে এবং চাষিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা না গেলে কৃষকরা অন্য ফসল চাষে আগ্রহী হবেন না।


ফকিরাবাদ এলাকার তামাক চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, তামাক বিক্রির জন্য কোন ঝামেলা নেই। তামাক চাষ করার জন্য চাষিদের উৎসাহিত করেন বিভিন্ন কোম্পানি। অগ্রিম ঋণ এবং কার্ডের মাধ্যমে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো সার ও বীজ সরবরাহ করে থাকে। তারাই তামাক ক্রয় করে থাকে।

ছকিনা বেওয়া বলেন, আমার স্বামী মারা গেছে অনেক আগেই। সংসার চালাতে পারি না। তামাকের এই সময়ে আমরা কাজ করলে কিছু টাকা পায়।

তিনি বলেন, মাসে ৯ হাজার টাকা পায়। তামাক বাছাই থেকে শুরু করে আগুনে জ্বাল দেওয়াসহ নানান কাজ করতে হয়। অসুখ বিসুখ লেগেই আছে তারপরও এই কাজ করতে হয়।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ গৌতম কুমার রায় বলেন, তামাক চাষের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ব।

তিনি বলেন, এক একর জমির তামাক জ্বালাতে ভাটিঘরে ৫ মেট্টিক টন জ্বালানি হিসেবে খড়ির প্রয়োজন হয়। এতে করে বৃক্ষ উজাড় হয়। তামাক জ্বালানো সময় যে ধোয়া বের হয় তাত ছত্রাক নিকোটিন ও কেমিকেল টেষ্টিসাইড ড্রকিসহ নানাবিধ উপাদান থাকে তা বাতাসে মিশে যায় তদ্রূপ চারাগাছ বড় করা পর্যন্ত যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেই জমিগুলো থেকে বৃষ্টির পানিতে ভাসতে ভাসতে নালা হয়ে নদীতে চলে যায় তখন ২১৪ প্রজাতির জলস্প্রাণী ধ্বংস হয়। তাতে করে আবাসস্থল ধ্বংস হয় তারা প্রজনন করতে পারেনা। নিকোটিনের ধোয়া মারাত্মক বিষাক্ত।

তামাকের চাষ করতে যেয়ে মাটি নষ্ট হচ্ছে, ফসল হচ্ছে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া হচ্ছে না। মেয়ে ও শিশুরা রোগাক্রান্ত হয়েছে। বন উজাড় হচ্ছে বায়ু দূষণ হচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলেও জানান তিনি।

জেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য ও সাফের নির্বাহী পরিচালক মীর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘গ্রামে তামাক চাষের জন্য কৃষকের পাশাপাশি ঘরের বৌ-ঝিদের (নারী) এ কাজে সহায়তা করা লাগে, পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষার্থী স্কুলে না গিয়ে তামাকের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। তামাক ভাঙার পর জ্বালানো এবং প্রসেসিং করতেও নারীদের দিয়ে এসব কাজ করা লাগে। অনেক সময় গর্ভবতী মহিলারাও এসব কাজের ফলে তাদের ভূমিষ্ঠ সন্তানরা বিকলাঙ্গ হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘জেলার সবচেয়ে বেশি তামাকের চাষ হয় মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলায়। আর এই দুই উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধীর জন্ম হয়। আসলে কি পরিমাণ তামাকের চাষ হয় এ জেলায় তার সঠিক নিরূপণ তথ্য নেই কারও কাছে। তবে কৃষি অফিস কেবল মনগড়া একটা তথ্য দিয়ে থাকে। বেশি বেশি করে তামাক চাষ বিরোধী সচেতন ও ক্যাম্পেইন করার পাশাপাশি কৃষকদের তামাকের বিকল্প সবজী বা অন্য ফসল উ'ৎপাদন এবং দাম নিশ্চিত করতে হবে এবং এসব চাষে দাম পড়ে গেলে বা ক্ষতিসাধন হলে কৃষকদের তা পুষিয়ে ওঠার জন্য শস্যবীমার চালুর দাবি জানান তিনি।  

তবে, মিরপুরের কয়েকটি এলাকায় তামাক আবাদ নিরুৎসাহিত করতে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দিশা’।

দিশার কৃষিবিদ জিল্লুর রহমান কাজ করছেন প্রায় ৬ বছরের বেশি সময় ধরে। প্রথমে বারুইপাড়া ইউনিয়নের কেউপুর গ্রামে তারা কাজ শুরু করেন। কৃষকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পান। যেসব কৃষক তামাক আবাদ ছাড়তে চান তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সার, বীজ ও বালাইনাশক দিয়ে সহযোগিতা করছে এ সংস্থাটি। সরকারের কৃষি বিভাগের পাশাপাশি পিকেএসএফের সহযোগিতায় ও দিশার বাস্তবায়নে আমরা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের সাথে যোগাযোগ রেখে এই কৃষিখাতকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি।

দিশা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, মিরপুর উপজেলায় আমরা ১১০০ কৃষককে অন্য ফসল আবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করে তামাক চাষ থেকে ফিরিয়ে আনতেসেক্ষম হয়েছি। যেসব ক্ষেতজুড়ে আগে তামাকের আবাদ করতেন কৃষকরা সেখানে শীতকালীন নানা শাক-সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ফল ও সরিষা আবাদ করছেন তারা। সবজির বাজারদর তুলনামূলক ভালো থাকায় কম পরিশ্রম ও অল্প পুঁজিতে বেশি আয় হচ্ছে।


কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় তামাক উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় উর্বর জমিতেই বেশি আবাদ হচ্ছে।

সূত্র আরো জানায়, এ তিন উপজেলায় ধান, গম, আখ, পাট, তিল, ডাল, তেলসহ নানা জাতের খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পরও উৎপাদিত ফসলের প্রায় অর্ধেক বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে বেড়েছে তামাক চাষ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে জেলায় প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।

মিরপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, উপজেলায় আবাদি জমির পরিমাণ ২৪ হাজার ৩০ হেক্টর। এর মধ্যে চলতি বছর তামাক চাষ হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরে। আগে এসব জমিতে গম, মসুর, ছোলা, মটর, ভুট্টা, সরিষার আবাদ হত। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও আড়াই হাজার টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকত। কিন্তু তামাক চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।

এ কারণে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত ও বিকল্প লাভজনক ফসল আবাদে চাষিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। তার পরও কোম্পানিগুলোর নগদ অর্থ প্রদানসহ বিভিন্ন উপকরণ সহায়তা দেয়ায় তার আবাদ আশানুরূপভাবে কমেনি। তিনি আরো জানান, এ অঞ্চলের বাস্তবতা বিবেচনা করে বিকল্প ফসল উৎপাদনে সরকারিভাবে সার-বীজ, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রণোদনা হিসেবে দিলে সাড়া পাওয়া যাবে। না হলে তামাক চাষ অব্যাহত থাকলে জেলায় প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দৌলতপুর অটিজম ও প্রতিবন্ধী স্কুলের প্রধান শিক্ষক সালেহ কবির মাজনুন পান্না বলেন, আমাদের এই উপজেলার প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক সময় নারীদের দিয়ে তামাকের কাজ করানো হয়। ফলে তাদের সন্তান ধারণ করতে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় এ কাজে সম্পৃক্ত থাকলে শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে। তাই এই উপজেলায় ব্যাপক পরিমাণে তামাকের আবাদ হয়ে থাকে এবং নারীরা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় প্রতিবন্ধীর হার বেশি বলেও মনে করেন তিনি।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, তামাক উৎপাদনে সময় লাগে ছয় মাস। অথচ একই মৌসুমে সমপরিমাণ জমিতে তিন মাসের ফসল হিসেবে গম, মসুর, ছোলা, মটর, ভুট্টা, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করে দ্বিগুণ আয় করা সম্ভব। তামাক চাষ বন্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা আমাদের নেই। চাষিদের নিরুৎসাহিত করতে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা সচেতন হলে অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. আকুল উদ্দিন জানান, তামাকের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তামাক চাষ ও সেবন কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ মানবদেহের স্পর্শকাতর অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে। জেলায় এবারও বিপদজনক মাত্রায় তামাক আবাদ হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //