শেরপুরে দেড়শ বছর ধরে জনপ্রিয় মাসকলাইয়ের জিলাপি

ভোজন রসিক বাঙালির ইফতার মানেই বাহারি রকম ও স্বাদের বিভিন্ন খাবার। ইফতারি প্লেটে চাই খেজুরসহ বিভিন্ন বিদেশি ফল। সেই সাথে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ইফতারের প্লেটে যুক্ত করতে বাঙালি রোজাদারদের একটি চিরচারিত নিয়ম। শেরপুর জেলায় এমনই একটি মিষ্টি খাদ্য রয়েছে যা কিনা ইফতারের সাথে চাইই চাই। সেটি হলো মাসকলাই ডালের তৈরি জিলাপি। মাসকলাই ডালের এই জিলাপি ইফতারের প্লেটে অন্য সকল মিষ্টিকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রায় দেড়শ বছর ধরে।

জানা গেছে, শেরপুর শহরের মিষ্টি ব্যবসার মূল কেন্দ্র গোয়ালপট্টির (ঘোষপট্টি) প্রায় ১০/১২ টি মিষ্টির দোকানে মাসকলাই ডালের জিলাপি তৈরি করা হয়। রোজা শুরু হলেই শেরপুর শহরের গোয়ালপট্রির মিষ্টির দোকানগুলোতে মাসকলাইয়ের জিলাপির কদর বাড়ে। তবে এ মাসকলাইয়ের জিলাপি কেবল রমজান এবং হিন্দু ধর্মীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে বানানো হয়। এছাড়া বছর জুড়ে কোন দোকানেই ওই মাসকলাই জিলাপি পাওয়া যায় না। এই জিলিপি বানানোর আগে মাসকলাই ডাল ভালোভাবে ধুয়ে তা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় কিছুক্ষণ। এরপর হাতে শীল-পাটায় অথবা মেশিনের সাহায্যে ওই ডাল পিষিয়ে নরম করা হয়। পরবর্তীতে ওই ডালের সাথে সামান্য কিছু চালের গুড়া বা বেসন দিয়ে জিলিপি তৈরির মূল উপাদান তৈরি করা হয়। এরপর কাপড়ের মধ্যে রেখে তা চেপে ধরে গরম তেলের মধ্যে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই তেল থেকে জিলিপিগুলো তুলে চিনির রসের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে তুলে ফেলা হয়। এরপর এ জিলাপি বিক্রি করা হয়।


জিলাপি ক্রয় করতে আসা কয়েকজন রোজাদার বলেছেন, এই মচমচে রসালো জিলাপি ইফতারে প্রশান্তি দেয়। শহরের গোয়ালপট্টিতে এই জিলাপি তৈরি শুরু করেন দুপুরের পর থেকে। এসময় জিলাপি তৈরির দৃশ্য ও মুহুমুহ গন্ধ রোজাদারদের প্রলুব্ধ ও ভিন্ন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বেলা যতই পড়তে থাকে দোকানগুলোতে মাসকলাইয়ের জিলাপির ক্রেতার ভিড় ততই বাড়ে। গরম গরম এই জিলাপি খুব মজাদার, ঠান্ডা হলে স্বাদ তেমন থাকে না। তাই বিকালের দিকে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গরম জিলাপি পেতে। ওদের ক্রেতারা জানায়, প্রতি বছরই প্রতি কেজি জিলাপির দাম বেড়েই চলছে। তারপরেও যেহেতু ইফতারের জন্য এই জিলাপি খেতে হয় তাই দামের দিকটা হিসাব করা হয় না।

এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডাল তেল চিনিসহ সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই জিলাপির দামও বেড়েছে। রোজাদারদের পছন্দের তালিয়ায় এই মাসকলাইয়ের জিলাপি থাকে। সারা বছর এই জিলাপি সামান্য চাহিদা থাকলেও রোজায় চাহিদা থাকে তুঙ্গে। রোজায় প্রতিদিন গোয়ালপট্টি এলাকায় প্রায় মণ দশেক জিলাপি বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানায়।

শেরপুরের এই ঐতিহ্যবাহী মাসকলাই ডালের জিলাপি সুনাম জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ায় জেলার বাইরে থেকেও অনেকেই এই মাসকলাইয়ের জিলাপি নিতে আসেন। এছাড়া জেলার বিভিন্ন ইফতার মাহফিলেও এই জিলাপির বিকল্প নেই।


শহরের গোয়ালপোট্টি এলাকার নন্দ গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর স্বত্বাধিকারী ভোলানাথ ঘোষ জানান, শেরপুরে জমিদারি প্রথা শুরু থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে মিষ্টি তৈরির প্রচলন শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই নানা মিষ্টির পাশাপাশি এই মাসকলাইয়ের জিলাপিও তৈরি করা হতো। সেই থেকে আজও প্রতিবছর রোজার মধ্যে এই মাসকলাইয়ের জিলাপি বিক্রি করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দাম প্রতি বছরই কিছু কিছু বাড়লেও জিলাপির গুণগতমান একই রয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানায়, রমজানের পবিত্রতা ও রোজাদারদের বিবেচনায় বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে কোনরকম রঙ বা কেমিক্যাল ব্যবহার না এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ অতি সাবধানতার সাথে এই জিলাপি তৈরি হয়। তাই এর স্বাদ ও চাহিদা যুগ যুগ ধরে একই রকম রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //