নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার হবে না: বান্দরবান রিজিয়ন কমান্ডার

বান্দরবান সেনা রিজিয়ন ও ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার গোলাম মহিউদ্দি আহমদ বলেছেন, নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার হবে না। তাদের নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব। যারা শান্তিপূর্ণভাবে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে চায়, জুমচাষ করতে চায় অথবা লেখাপড়া করতে চায় তাদের সবার জন্য সেনাবাহিনী আগে যেভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে ভবিষ্যতেও দেওয়া হবে। যেকোনো ধরণের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে চালিয়ে যাব।

গোলাম মহিউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহবায়ক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তাদের উদ্যোগ, প্রচেষ্টা এবং লক্ষ্য অর্জনে লেগে থাকা বিরামহীন চেষ্টার ফলে এখন অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছি। একটা পর্যায়ে আরো স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিছু কিছু সমস্যার কথা শুনেছি। এগুলো দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

‘‘জেলা পরিষদ কাজ করছে। পাড়াবাসীর পক্ষ থেকে একটা তালিকা পেলে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা সামগ্রী নিয়ে চলে আসব। বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আন্তরিক। সেনাবাহিনী আগে থেকে ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো একটি সম্প্রীতির বান্দরবান। যেখানে সকল লোক পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার আলোকে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে।’’

পাহাড়ে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের জেরে ভয়ে পালিয়ে থাকা বম সম্প্রদায়ের লোকজন ফিরে আসায় পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। 

গতকাল রবিবার (২৬ নভেম্বর) সকালে রোয়াংছড়ি সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ক্যাপ্লাং পাড়া ও পাইক্ষ্যং পাড়ার মাঠে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন ও জেলা পরিষদ এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে ক্যাপ্লাং পাড়া, দুর্নিবার পাড়া, খামতাং পাড়া ও পাইক্ষ্যং পাড়ার মোট ১১০ পরিবারকে খেলাধুলা ও শিক্ষা সামগ্রী, শুকনা খাবার, শীত বস্ত্র, চাল ও নগথ অর্থ বিতরণ করা হয়।

সেনাবাহিনী, জেলা পরিষদ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সহযোগিতায় রোয়াংছড়ির পাইক্ষ্যং পাড়ায় নতুন করে ফিরেছে আরো ২৩ পরিবার। এর আগে ফিরেছেন ৫৭ বম পরিবার। এ নিয়ে এই পাড়ায় ফিরে আসার পরিবার সংখ্যা দাড়াল ৮০ পরিবার। আরো ২৩ পরিবারের মত লোকজন এখনো পাড়ায় ফেরেনি বলে জানিয়েছেন পাড়ার (গ্রামপ্রধান) কারবারি পিটর বম।

এছাড়া নিজ ভিটায় ফিরেছেন দুর্নিবার পাড়া ২৭ জন, ক্যপ্লাং পাড়ার ১৭ জন এবং থানচির প্রাতা পাড়ার ১৪ পরিবারে ৪৯ জন।

অনুষ্ঠানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহবায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা বলেন, সবার আন্তরিক সহযোগিতার আগে কেএনফের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি সুন্দরভাবে বৈঠক করতে পেরেছে। বাঙ্গালিসহ এখানকার ১২টি জনগোষ্ঠী আগের মত শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে। সবাই যাতে ভালভাবে থাকতে পারে জেলা পরিষদ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। ফিরে আসা পরিবারদের আরো ত্রাণ দেওয়া হবে। তাদের আরো কী কী প্রয়োজন নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে তালিকা দিলে জেলা পরিষদ ব্যবস্থা করবে। 

তিনি আরো বলেন, ডিসেম্বর থেকে আবার জুমের মৌসুম শুরু হবে। অনেক জায়গায় জঙ্গল কাটা শুরু হয়ে যাবে। পাড়ায় কারা কারা জুমচাষী কৃষি বিভাগকে একটা তালিকা করতে বলব। তারা সেখানে সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বীজ সংগ্রহ করে দেওয়া হবে। পাড়ার একটা কমিউনিটি সেন্টার ও যুব সংগঠনের অফিস স্থাপনের জন্য পরবর্তীতে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে পাইক্ষ্য মৌজার হেডম্যান বৈথাং বম বলেন, সেই সময় পরিস্থিতির কারণে যে যার মত করে কেউ বনজঙ্গলে পালিয়েছিল। কেউ আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পাড়াবাসীদের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু আট মাসের মত পালিয়ে থাকায় সবাই শূন্য হাতে ফিরেছে। আরো ত্রাণ সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। এগুলো তালিকা করে জানানো হবে।

অনুষ্ঠানে বান্দরবান সদর জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহমুমুদল হাসান, জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা, বম সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম, রোয়াংছড়ি ইউএনও খোরশেদ আলম চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান চহাইমং মারমা ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান মেহ্লাঅং মারমা উপস্থিত ছিলেন।

২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক লোকজন রয়েছে। যার কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়। 

কেএনএফের ফেসবুক পেইজে তারা জানায়, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সেই সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ।

স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ৩০ মে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধি নিয়ে তৈরি করা হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। পরে জুন মাসে শেষ সপ্তাহে জেলা পরিষদের সভা কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির গঠন ও উদ্দেশ্য।

১৮ সদস্যের এই শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটি আহবায়ক হিসাবে রয়েছেন বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগরে সভাপতি ক্য শৈ হ্লা মারমা এবং সদস্য সচিব হিসাবে রয়েছে বম সোস্যাল কাউন্সিলে সভাপতি লালজারলম বম। জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যাকে কমিটির মুখপাত্র হিসাবে রাখা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বান্দরবান জেলায় কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ); যা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এই সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে গত বছর অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র‌্যাব। 

এরপর গত বছর ১৭ অক্টোবর থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র‌্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। ইতিমধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও। সংঘাতে প্রাণ গেছে কেএএনএফ সদস্যেরও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে কয়েক দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়ে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে তিন উপজেলা থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা নেওয়া হলেও রোয়াংছড়ি উপজেলায় দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণে এখনো নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //