হুমকিতে টাঙ্গুয়া হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

মাদার ফিশারিজ খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওরে বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে দুটি রূপ দেখা যায়। তবে শুষ্ক মৌসুমের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে দেশি বিদেশি প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকের আগমন বেড়ে যায়। আর আগত পর্যটকদের মধ্যে বেশিরভাগ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

তবে বর্ষায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক ও তাদের পরিবহনকারী নৌকা ও হাউস বোটের অবাধ চলাচলে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়াও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগও রয়েছে হাউস বোট ও নৌযানগুলোর বিরুদ্ধে আগত পর্যটকদের। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মাদার ফিশারিজ খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর স্থানীয় লোকজনের কাছে নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট, প্রথমটি সুন্দরবন। ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে হাওরটি জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার, বাকি অংশ কৃষিজমি ও ৬৮টি গ্রামের মানুষের বসতি। 

১৯৯৯ সালে সরকার এই এলাকাকে বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা ও ২০০০ সালে ইউনেস্কো রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এই হাওরের বিরল প্রজাতির মাছ ও অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। পৃথিবীব্যাপী অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন ২৬ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল এই হাওর। এ হাওর এখন আর আগের মতো নেই।

সরেজমিনে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসে তাহিরপুর, মধ্যনগর ও সুনামগঞ্জ জেলায়। এরপর তারা নৌকা ও হাউস বোটে করেই আসছে হাওরে। তারা হাওরে আসার পথেই উচ্চ শব্দের সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নেচে-গেয়ে হাওরে প্রবেশ করছেন। টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় গিয়ে নৌকাগুলো করচ গাছে বেঁধে রাখা হয়। ফলে এই এলাকায় থাকা শতাধিক হিজল করচ গাছের ডাল-পালাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ারে নৌকা বাঁধার ফলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই স্থাপনাটি।

ওয়াচ টাওয়ারে উঠে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে হাওরের স্বচ্ছ পানিতে গোসলে নেমে হইহল্লা করে আনন্দ করে নৌকায় ভাসমান দোকান থেকে চা নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে গোসল সেরে নিচ্ছেন, কেউবা বিস্কুট পটেটো চিপস খাচ্ছেন। কেউবা ছোট নৌকা নিয়ে হাওরের করচ বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউবা ছবি তুলে রাখছেন স্মৃতি ধরে রাখতে। আবার স্থানীয় ছোট ছোট শিশুর কণ্ঠে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া গান শুনছেন হাউস বোট ও নৌকায় বসেই। হাওরের বিভিন্ন অংশে ঘুরছেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। আর তাদের থাকা খাওয়া ও ব্যবহৃত পানির বোতল, প্লাস্টিকের পণ্য আর মল-মূত্র পানিতে ফেলায় পানি ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

তাহিরপুর নৌ চালক মালিক সমিতির সভাপতি শাহীনুর তালুকদার জানান, আমরা স্থানীয়রা নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলাচল করলেও বাইরের নৌকা ও হাউস বোট নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হাওরে চলাচল ও বিভিন্ন প্লাস্টিকের পণ্য পানিতে ফেলছেন। এর দায় আমাদের নিতে হচ্ছে। 

হাওর ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের বাসিন্দা আহমেদ কবির। তিনি জানান, যেখানে নিবিড়ভাবে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার কথা সেখানে আগত পর্যটকরা উচ্চ শব্দে গান বাজানোসহ নিয়মনীতিহীন কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হাওর পাড়ের বাসিন্দারা। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। কারণ টাঙ্গুয়ার হাওরে সর্বত্র বিচরণ করছে পর্যটক পরিবহনকারী নৌকা ও হাউস বোটগুলো। 

জেলা প্রশাসক দিদারের আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, পর্যটনকে উৎসাহিত করতে প্রচলিত আইন-কানুনের আলোকে একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে পরিকল্পিত পর্যটন করা সম্ভব হবে। সকল নৌযানকে নীতিমালা অনুসারে চলাচল করতে হবে। হাওরের ক্ষতি হয় এমন কাজ কাউকেই করতে দেওয়া হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //