ছাত্রলীগ নেতার হাতে মধ্যযুগীয় নির্যাতনের শিকার ৪ যুবক

রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার এক ছাত্রলীগ নেতার ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন চার যুবক। যাদের একজনকে কোমরপর্যন্ত মাটিতে পুতে নির্যাতন করা হয়, আরেকজনকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রেখে নির্যাতন করেন।

টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর ওয়াদুদ শুভ ও তার সহযোগীরা এই দুই যুবককে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেন। গতকাল শুক্রবার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি আলোচনায় আসে।

চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে মোহন আলী (২২) ও তার প্রতিবেশী আতাহার মিয়ার ছেলে মছু মিয়া (২০) এরকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

জানা যায়, মোহনকে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং মছুকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুতে পেটানো হয়েছে। গত ৯ জুলাই দুপুরে মালেকার মোড় থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়।

তাদের মাটিতে পুতে ও পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, একটি পুকুরের হাঁটু পানিতে হাত-পা বেঁধে পলককে ফেলে রাখা হয়েছে। পানির মধ্যে একটি খুঁটির সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হয়। মাঝে মাঝে চেষ্টা করে মাথা তুলে শ্বাস নিচ্ছে। আর পাশে একজন দাঁড়িয়ে দেখছে এবং আরেকজন স্বীকারোক্তি আদায় করার ভিডিও করছে।

মোহনের মা শলুয়া ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ সদস্য নাসিমা বেগম জানান, গত ১ জুলাই প্রতিবেশী পারুলের বাড়ি থেকে গরু বিক্রির এক লাখ ৬০ হাজার টাকা চুরি যায়। এ ঘটনায় সন্দেহজনকভাবে মছুকে তুলে নিয়ে গিয়ে কানাজগাড়ি বিলের মধ্যে একটি পুকুর পাড়ে মাটিতে পুতে নির্যাতন করেন। এসময় তিনি মোহনের নাম বলে। পরে তারা মোহনকে তুলে নিয়ে যায়। তাকে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করে টাকা চুরি করার স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শুভ ও মুক্তা এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় তারা ভয়ে থানায় অভিযোগ করেননি।

নির্যাতনের শিকার মোহন বলেন, আমি মালেকার মোড়ে কাঠ মিলে কাজ করছিলাম। এসময় শুভ, মুক্তা, মিজান গিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে আসে। তারা আমার হাত-পা, মুখ-চোখ বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রেখে নির্যাতন করেন। তাদের নির্যাতনে আমার শরীর এখনো অকেজো হয়ে আছে। এখন ভারি কাজ করতে পারি না।

পারুল বলেন, আমার বাড়িতে গরু বিক্রির এক লাখ ৬০ হাজার টাকা ছিল। মছু আমার বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে এটা সত্য। তবে আমি কাউকে টাকা উদ্ধার করে দিতে বলিনি। মুক্তা ও শুভ কেন এসব করেছে আমি জানিনা। শুনেছি মুক্তা মছুর কাছ থেকে কিছু টাকা উদ্ধার করেছে। তবে সেই টাকা আমাকে সে দেয়নি।

এ ঘটনার পর চারঘাটের ওই ছাত্রলীগ নেতার ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরো দুই যুবক। যাদের একজনকে নির্যাতন করে হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফেনসিডিল বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর ওয়াদুদ শুভ ও তার সহযোগীরা ওই দুই যুবককে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেন।

নির্যাতনের শিকার যুবকরা হলেন, শলুয়া ইউনিয়নের কানাজগাড়ি গ্রামের আবু বক্করের ছেলে নুর মোহাম্মদ পলক (১৮) ও তার খালাতো ভাই একই গ্রামের সৈকত আলীর ছেলে শাকিল রহমান (২০)। এদের মধ্যে শাকিলকে চোখ-মুখ বেঁধে পিটিয়ে নির্যাতন করে হাত ভেঙে দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল ওয়াদুদ শুভ শলুয়া গ্রামের সাজেদুর রহমানের ছেলে। তার সহযোগীরা হলেন, শলুয়া গ্রামের সইমুদ্দির ছেলে সাব্বির হোসন, আনজু আলীর ছেলে মুক্তার হোসেন মুক্তা ও রমজান আলীর ছেলে লালন আলী। এরা সবাই মাদক কারবারের সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে একাধিক মামলাও রয়েছে বলে জানা গেছে।

শাকিল রহমান জানান, শুভ তার লোকজন নিয়ে চোদ্দপাই এলাকা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নির্যাতন করে বাম হাত ভেঙে দেয়। এর পর ওই অবস্থায় আমাকে রাস্তার পাশে ফেলে চলে যান। স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পাঠায়।

শাকিল বলেন, দুইদিন আগে শুভ ও মুক্তা আমার বাড়িতে এসে তাদের সরবরাহকৃত ফেনসিডিল বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। এতে রাজি না হলে আমাদের এভাবে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনার পর আবার রাত ১টার দিকে বাড়িতে গিয়ে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য হুমকি দিয়ে আসেন। প্রকাশ করলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।

ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল ওয়াদুদ শুভর দাবি, একটি পক্ষে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা নিতে তার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। মোহন ও মছু নির্যাতনের সময় বা এই ঘটনার সঙ্গে আমি কোনভাবে সম্পৃক্ত নই। এছাড়াও পলক ও শাকিলকে নির্যাতনেরও কথা অস্বীকার করে শুভ বলেন, তাদের আমি চিনি না। আপনারা ফোনে কথা না বলে সামনা সামনি এসে কথা বললে ভালো হয় বলে ফোন কেটে দেন।

চারঘাট মডেল থানার ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, মুক্তার, সাব্বির, লালনের বিরুদ্ধে মাদকের ৬/৭টি মামলা রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারও করেছিলাম। এখন জামিনে রয়েছে। নির্যাতনের অভিযোগ পেলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, এই ঘটনায় পুলিশ স্বপ্রনোদিত হয়ে একটি জিডি করেছে। আর নির্যাতনের শিকার ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদেরকে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। তবে তারা জানিয়েছেন এ বিষয়ে তারা অভিযোগ করতে রাজি নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //