মেজর সিনহা হত্যার ৩ বছর, অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর চান পরিবার

পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের তিন বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই হত্যা করা হয় তাকে। সিনহা হত্যা মামলার বিচারের রায় কার্যকর করার দাবিতে সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেল ৩টায় আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল করা হয়। নিহত মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের পরিবার ও কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্যদের উদ্যোগে কক্সবাজার শহরের শহীদ সুভাষ হলে (পাবলিক লাইব্রেরি হল) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। পুলিশের গুলিতে মেজর (অব:) সিনহা হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তখন ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তখন নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের গাড়ি থেকে কিছু ইয়াবা, গাঁজা ও মদ উদ্ধারের কথা বলে পুলিশ। পুলিশের এসব বক্তব্য নিয়ে দায়ের করা হয় একাধিক মামলা। কিন্তু ঘটনার পরদিনই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া’ এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়, গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ধরনের বিচার বহির্ভূতহত্যার ঘটনায় জনগণও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তাতে আলোচিত সিনহা হত্যা মামলা গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুত তদন্ত ও অভিযোগপত্র দায়েরের মাধ্যমে তা বিচারিক পর্যায়ে পৌঁছায়।

হত্যাকাণ্ডের ৫ দিনের মাথায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসসহ (পরে বিচারিক আদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত) ৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কক্সবাজার জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, এসআই, এএসআই, কনস্টেবলসহ কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রায় ১৪শ সদস্যকে কক্সবাজার থেকে একযোগে বদলি করা হয়। গঠিত হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (যুগ্মসচিব) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। এই কমিটি তদন্ত শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাসকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে। আদালত থেকে র‌্যাব-১৫ কে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়।

এরপর মামলার আসামি ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করে। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিনজন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এর তিন সদস্য এবং প্রদীপের দেহ রক্ষীসহ আরো মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ২০২১ সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে।

আসামিদের মধ্যে ১২ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতের কাছে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেন। শুধু ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাগর দেব আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেননি।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জনসাক্ষীসহ আলোচিত মামলাটির চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন র‌্যাব-১৫ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে মেজর (অব:) সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে কিছুদিন আদালতের স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তার আদালতে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু করেন।

কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদইসমাইল ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ৩০০ পৃষ্ঠার এমামলার ঐতিহাসিক রায় দেন। মামলায় দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা হয়। 

মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আসামিরা হলেন- বাহারছড়াপুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

এছাড়া একই রায়ে ছয় আসামি যথাক্রমে কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুলআমিন, মো. নিজামুদ্দিন, আয়াজ উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড  প্রদান করা হয়। রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ৮ জন আসামির প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

মামলার বাকি সাতজন আসামিকে মামলার দায় থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। তারা হলেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, কামাল হোসেন আজাদ ও মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ।

এ রায়ের পর বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তার দৃঢ় চেতা ও সাহসী রায়ের জন্য প্রশংসায় ভাসতে থাকেন। ফৌজদারী অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এ রায়কে একটি ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও দৃষ্টান্তমূলক রায় বলে অভিহিত করতে থাকেন।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা পরে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করে। হাইকোর্টে দায়েরকৃত আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে জানা গেছে।

মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিচার কার্যকর করার দাবিতে সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেল ৩টা আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। 

ক্ষতিগ্রস্ত ফরিদুল মোস্তাফা বলেন, ওসি প্রদীপের কারণে আজ আমি নিঃস্ব। তার ফাঁসি কার্যকর হলে আমরা কক্সবাজারবাসী খুশি হব। ফাঁসি কার্যকর করতে কাল আমরা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছি। আমাদের আন্দোলন সফল হবে। 

মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিতে আমরা একটি  রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করেছি। তবে উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন মৃত্যুদণ্ড আপিল শুনানি দ্রুত এর বিচার নিশ্চিত করা হোক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //