ঘূর্ণিঝড় মোখা: বরিশালে ৮-১২ ফুটের বেশি জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা

বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় আগামীকাল রবিবার (১৪ মে) আঘাত হানতে পারে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। তবে আজ শনিবার (১৩ মে) রাতেই উপকূলে এর প্রভাব শুরু হবে। গতিপথ পরিবর্তন না হলে পায়রা বন্দরের পূর্ব দিক থেকে আঘাত হানতে পারে ‘মোখা’। এর ফলে বরিশাল অঞ্চলে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা করছে আবহাওয়া অফিস।

তাই ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় বরিশাল বিভাগে সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রশাসন। এরইমধ্যে উপকূলে বসবাস করা মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে তারা।

বিশেষ করে ভোলা এবং পটুয়াখালী জেলার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে দুই জেলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে।

আর এই কাজে পুলিশ, সিপিপি, রেড ক্রিসেন্টসহ উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি তাদের সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান।

শনিবার বিকালে বরিশাল সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বিভাগীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা শেষে বিভাগীয় কমিশনার সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মোকাবেলায় বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩ হাজার ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং ৩৫টি মুজিব কেল্লা। যেখানে এক সঙ্গে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ৬০৬ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। পাশাপাশি নিরাপদে রাখা যাবে ১২ লক্ষ ৪১ হাজার ৪৯০টি গবাদি পশু।

এছাড়া ৫৯ লক্ষ ২০ হাজার ৮০৪ টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ, ২০ হাজার ৭০০ কম্বল, ৫৪৩ বান্ডিল টিন এবং ২ হাজার ৭০৮ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বিভাগীয় কমিশনার বলেন, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সিপিপি, রেড ক্রিসেন্ট, আনসার এবং পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকরা। আসন্ন ‘মোখা‘ মোকাবেলায় বিভাগে ৩৯ হাজার ৪২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন। এর মধ্যে তারা উপকূলীয় এলাকায় কাজ শুরু করেছে। মানুষকে সতর্ক করে মাইকিং, উপকূলের চরগুলোতে পতাকা উত্তোলন এবং উপকূলের মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন তারা।

এদিকে সভায় জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ৪৮টি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এরই মধ্যে চালু করা হয়েছে। তাছাড়া ঝড়ের কবলে অনেক মানুষ আহত হতে পারেন। এজন্য প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মোট ৩৫৭টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এছাড়াও পশুর চিকিৎসার জন্য পৃথকভাবে আরো ২১টি মেডিকেল টিম রয়েছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত পশুর চিকিৎসা দিবেন। এর পাশাপাশি সকল ধরনের ওষুধ, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হুমায়ুন শাহীন খান।

অপরদিকে সভায় ভার্চুয়ালী যুক্ত হয়ে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক বলেন, জেলার মধ্যে রাঙ্গাবালী, বাউফল, দশমিনা এবং কলাপাড়া উপজেলা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী উপজেলার তিনটি চর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে চরমোনতাজে একটি মাত্র সাইক্লোন সেল্টার রয়েছে। যেখানে মাত্র দুই হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। তবে চর বিশ্বাস, চর কাজল এবং চর হাদিতে কোন আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এসব চরের মানুষদের অন্য উপজেলায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।

অপরদিকে ভোলার জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, জেলার মধ্যে চরফ্যাশন এবং মনপুরা উপজেলা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব উপজেলার মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে দিনভর আকাশে তেমন মেঘ না থাকায় তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছে না। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশসহ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের বুঝিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

এদিকে দুর্যোগকালীন সময় সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল এবং ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সংযোগ দ্রুত সংস্কারে পল্লী বিদ্যুৎ এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তাদের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

অপরদিকে, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় বরিশাল বিভাগের সকল ফায়ার স্টেশন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা শুধুমাত্র উদ্ধার তৎপরতাই চালাবে না, ফায়ার সার্ভিস স্টেশনগুলোতে বিপদগ্রস্ত মানুষদের আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাছাড়া উদ্ধার তৎপরতায় কোন প্রকাশ সমস্যা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অপরদিকে নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার কফিল উদ্দিন বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও মানুষ তাদের প্রিয় ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছে না। এজন্য মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক জোড় করা হচ্ছে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মানুষের ঘরবাড়িতে যাতে চুরি-ডাকাতি না হয় সে বিষয়টিতে থানা পুলিশের পাশাপাশি নৌ পুলিশ তদারকি করছে বলে জানান তিনি।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা জানিয়েছেন লেবুখালী শেখ হাসিনা সেনানিবাসের লে. কর্নেল মো. হাবিবুর রহমান। সেনাবাহিনী যেকোনো দুর্যোগেই মানুষের পাশে থাকছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সেনানিবাস খুলনার বাগেরহাটসহ বরিশালের পাঁচটি জেলার দায়িত্বে আছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’ মোকাবেলায় পাঁচ জেলার জন্য আমাদের পাঁচটি টিম আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের জন্য পৃথকভাবে আরো ৩৭টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিমের পাশাপাশি উদ্ধার এবং ত্রাণ সহায়তার জন্য নৌযানও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রয়েছে। এসময় তিনি সকল সংস্থাকে সার্বক্ষণিক সেনাবাহিনীকে তথ্য প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমরা সেনাবাহিনী যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছি।

সভায় অন্যান্যদের মধ্য আরো বক্তব্য দেন- বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামান, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনসহ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ বিভাগ, সড়ক জনপদ, প্রাথমিক শিক্ষা উপ-পরিচালকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //