গণসংযোগে নৌকার মেয়র প্রার্থী, ঘোষণা দিয়েও পাশে নেই আ.লীগ নেতারা

মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নেমেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। গতকাল মঙ্গলবার তিনি বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে গণসংযোগ শুরু করেন।

এরপর চকবাজার হয়ে লাইন রোড পর্যন্ত নির্বাচনী গণসংযোগকালে পথচারী, শ্রমজীবী মানুষ এবং ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের হাতে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এসময় তিনি বরিশাল নগরীর উন্নয়নে আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন।

এদিকে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু করলেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের পাশে দেখা যায়নি বরিশাল মহানগর বা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে। শুধুমাত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আফজালুল করিম এবং জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি শাহজাহান হাওলাদারসহ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অনুসারীরা ছিলেন তার গণসংযোগে।

এছাড়া একইদিন বিকালে নগরীর সদর রোডে সার্কিট হাউজের সামনে প্রধান নির্বাচন কার্যালয়ে আওয়ামী ওলামা লীগের সাথে মতবিনিময় করেন আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। সেখানেও দেখা যায়নি মহানগর আওয়ামী লীগের নেত্রীত্ব স্থানীয় নেতাদের।

তবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংযোগ শুরু করলেও বিষয়টি অবগত নন বলে দাবি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীরের। এমনকি নির্বাচনী কোন সভা-সমাবেশেও রাখা হচ্ছে না তাদের। দলীয় প্রার্থী হয়েও নির্বাচন কার্যক্রমে পক্ষপাতিত্ব দলের মধ্যে বিবেধ আরো বাড়িয়ে দিবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, মেয়র প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পরে মঙ্গলবার প্রথম আনুষ্ঠানিক গণসংযোগ শুরু করেছেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। ইতিপূর্বে দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে ঘরোয়া বৈঠক এবং সভা-সমাবেশ করলেও মাঠপর্যায়ে গণসংযোগে দেখা যায়নি তাকে।

গণসংযোগ শুরুর প্রথমদিন সকালে তিনি বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যান। সেখানে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন খোকন সেরনিয়াবাত। এরপর সেখান থেকে নগরীর দক্ষিণ চকবাজার হয়ে লাইনরোড পর্যন্ত পায়ে হেটে গণসংযোগ করেন তিনি।

গণসংযোগকালে খোকন সেরনিয়াবাত কোন ব্যক্তির কথা না ভেবে নৌকায় ভোট দেয়ার দাবি জানান পথচারী, শ্রমজীবী মানুষ এবং ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে। এসময় তিনি বিগত ১০ বছরে বরিশাল সিটি করপোরেশনে কোন উন্নয়ন হয়নি দাবি করে বলেন, আমি নির্বাচিত হলে বরিশাল নগরীকে আধুনিক ও উন্নত নগরীতে পরিণত করবো। নগরভবনকে জনবান্ধন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি সকল ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস মুক্ত নগরী হিসেবে একটি নতুন বরিশাল গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন খোকন সেরনিয়াবাত।

এদিকে বিকাল ৪টায় তিনি তার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে মহানগর আওয়ামী ওলামা লীগের সাথে মতবিনিময় করেন মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। এসময় উপস্থিত ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আফজালুল করিম, সহ-সভাপতি আনিস উদ্দিন আহমেদ শহীদ, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মাহামুদুল হক খান মামুনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এরপর নিজ বাসায় মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।

এছাড়া সন্ধ্যায় নগরীর লঞ্চঘাট এলাকায় গণসংযোগ শেষে মহান মে দিবস উপলক্ষে ডিসি ঘাটে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন খোকন সেরনিয়াবাত। সবশেষ রাতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় করেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি লস্কর নুরুল হক।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন আমেনা বেগমের ছোট ছেলে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লার ছোট ভাই ও বর্তমান সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর আপন চাচা।

আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরে গত ১৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে বরিশালে আসেন খোকন সেরনিয়াবাত। ওইদিন দলীয় কার্যালয়ের সামনে মেয়র প্রার্থীকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুসসহ মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনীত মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে থেকে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করার ঘোষণা দেন তারা। তবে মঙ্গলবার মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত আনুষ্ঠানিক গণসংযোগ শুরু করলেও একমাত্র আফজালুল করিম ছাড়া বাকিদের দেখা যায়নি প্রার্থীর পাশে।

এ প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংযোগ শুরু করলেও বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ আমাকে এ বিষয়ে জানায়নি। তবে আমরা কেউ নৌকার বিপক্ষে নয়। কেননা নৌকা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক। এখন না থাকলেও নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে সামনে সবাই থাকবে বলেন তিনি।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সদস্য লস্কর নুরুল হক বলেন, আমরাদের আনুষ্ঠানিক গণসংযোগ এখনো শুরু হয়নি। প্রতীক পাওয়ার পরে শুরু করবো। তবে মঙ্গলবার সকালে প্রার্থী বরিশালের মানুষের সাথে পরিচিতি এবং সৌজন্য সাক্ষাত করার জন্য বের হয়েছিলেন। আর এটা তিনি করতেই পারেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ দলীয় প্রার্থীর পাশে না থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা আছি সবাই আওয়ামী লীগের লোক। এখানে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য বলরাম পোদ্দার, মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আফজালুল করিম, সহ-সভাপতি আনিস উদ্দিন শহীদ, মহানগর যুবলীগের আহবায়ক নিজামুল ইসলাম নিজাম, যুগ্ম আহবায়ক মাহামুদুল হক খান মামুন, সাহিন সিকদার, মহানগর শ্রমিকলীগের সভাপতি আফতাব আহমেদ, জেলা শ্রমিকলীগের শাহজাহান হাওলাদার, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য অসীম দেওয়ান, বিএম কলেজের সাবেক ভিপি মঈন তুষারসহ সবাই আছেন।

তিনি বলেন, যারা বলছেন প্রার্থীর সাথে কেউ নেই তারা ভুল বলছে। তবে হ্যাঁ কিছু নেতাকর্মী আছে যারা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তাদের মনে ব্যথা আছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে। আমি মনে করে যারা আওয়ামী লীগকে এবং নৌকাকে ভালোবাসে তারা কেউ ঘরে বসে থাকবে না। আমার বিশ্বাস তারাও নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে এক কাতারে আসবেন।

প্রসঙ্গত, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে একক প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করে কেন্দ্রে নাম পাঠায় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। কিন্তু মনোনয়ন দেয়া হয় তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে। এতে ক্ষুব্ধ এবং হতাশ হন সাদিক আবদুল্লার সমর্থকরা। এ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে মহানগর আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ। যার বহিপ্রকাশ ঘটে গত সোমবার মে দিবসের দিন। এদিন দলীয় কার্যালয়ের সামনে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ এবং র‌্যালি করেন তারা।

এদিকে, গত ২৭ এপ্রিল দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নানা নাটকীয়তা শেষে ওইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের ঘোষণা করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেনি দলটি। আগামী ৮ এপ্রিল তাদের প্রচার-প্রচারণা শুরুর কথা রয়েছে।

তবে অনেক আগে থেকেই নির্বাচনের মাঠে সক্রিয়ভাবে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টির মনোনীত মেয়র প্রার্থী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস। এরই মধ্যে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে ঘরোয়া মতবিনিময়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন। তাছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচার প্রচারণা এবং গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপন ও অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আলী হোসেন হাওলাদার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //