যশোরে ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্য

যশোরে বসন্ত ঋতুতে ৫০ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনার লক্ষ্য নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ঋতুতে তিনটি বিশেষ দিবসকে কেন্দ্র করে মূলত টার্গেটে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

পহেলা ফাল্গুন বা বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই তিনটি দিবসে ফুল অতি প্রয়োজনীয়। পহেলা ফাল্গুন বসন্তকে বরণ করে নিতে রঙিন ফুলের জুড়ি নেই। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনকে দেয়া গোলাপের সুঘ্রাণে ভালোবাসা বেড়ে যায় বহুগুণ। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহিদদের স্মরণে দেয়া হয় ফুল। একারণে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালীজুড়ে উৎসবের আমেজ বয়ে চলে। ফলে তিন দিবস ঘিরে গদখালী ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। বাজার ধরতে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ত সময় পার করছেন এই অঞ্চলের ফুলচাষিরা। অনুকূল আবহাওয়া ও বাজার পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, এ মাসে তাদের বেচাকেনা প্রায় ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে ঘূর্ণিঝড় আমফান ও করোনার ক্ষতি পুষিয়ে লাভের স্বপ্ন দেখছে ফুলচাষিরা।


যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে চাষিরা ফুলক্ষেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রয়োজনমাফিক পানি দেয়া, স্প্রে করা, আগাছা নিড়ানো, মরা-রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলাসহ ক্ষেত পরিচর্যায় তাদের দম ফেলবার সময় নেই। পাশাপাশি ক্ষেত থেকে ফুল তুলে নিয়ে ছুটছেন গদখালি ফুলবাজারে। দূর-দূরান্তের ক্রেতারাও হাজির হচ্ছেন সেখানে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণা আর হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠছে গোটা এলাকা। গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ফুলের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শত শত ফুলচাষী। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ফুলের দাম নিয়ে হাক-ডাকে ব্যস্ত। ফুলের চাহিদা বাড়তি থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ফুল কিনছেন এই বাজার থেকে। একই সাথে বেশি দাম পাওয়ায় ফুল চাষিরাও বাজারে দ্বিগুণ ফুল এনেছেন। সবমিলিয়ে ফুল-বেচাকেনা জমে উঠায় ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের মনে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য মতে, যশোরে প্রায় ৭ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। তারা অন্তত ৭ শতাধিক হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষ করেন। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলার বিভিন্ন মাঠে ফুল চাষ হয়ে থাকে। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, ক্যালেন্ডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ হচ্ছে। ডিসেম্বরে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস থেকে শুরু ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস এবং মার্চে স্বাধীনতা দিবস ও পরে পহেলা বৈশাখ দিয়ে গোটা মৌসুম জুড়ে ফুল বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের ফুলচাষিরাই দেশের ৭০ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়।

গদখালী ফুলবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বসন্ত ও ভালবাসা দিবসকে ঘিরে ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। লাল গোলাপ ফুল প্রতি পিস ২০-২২ টাকা, চায়না গোলাপ লংস্টিক রোজ ৩০-৩৫ টাকা, ক্যাপ গোলাম ১০-১২ টাকা, রজনীগন্ধা স্টিক ১১-১২ টাকা, গ্লাডিওলাস ফুল রঙ ভেদে ১৪-১৫ টাকা, ভুট্টা ১১-১২ টাকা, জারবেরা প্রতিটি ১০-১৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পাশাপাশি চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৪ টাকায়, গাঁদা প্রতি হাজার সাড়ে তিনশ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা, রডস্টিক প্রতি বান্ডিল ১৫০ টাকা, জিপসি ফুল প্রতি আঁটি ১০০ টাকা, মকমল ৪-৫ টাকা, ভ্যারাটিস ৭-৮ টাকা, হলুদ ১৪-১৫ টাকা, সিঁদুর ১৫-১৫ টাকা, বিশ্বসুন্দরী ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


গদখালী বাজার কমিটি ও গ্রায়ার্স সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল হোসেন জানায়, এবার ফুলের বাজার খুবই জমজমাট। ফুলের দামে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা খুবই খুশি। 

ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন জানান, রবিবার তিনি প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার ফুল ক্রয় করেছেন। তিনি চারটি জেলায় তার ক্রয়কৃত ফুল বিক্রি করবেন। 

ফুলচাষী ও ব্যবসায়ী ওজিয়ার রহমান জানান, শুধুমাত্র রবিবার প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার ফুল বিক্রয় হয়েছে।

পানিসারা গ্রামের ফুলচাষী হাবিবুর রহমান জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ফুলের চাষ ও উৎপাদন ভালো হয়েছে। সামনের তিন উৎসব ঘিরে ফুলবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। বাজার পরিস্থিতিতে ফুলচাষিরা খুশি।

ফুলচাষী ও বিক্রেতা মোমিনুর রহমান জানান, এখন যে দামে ফুল বিক্রি হচ্ছে, তা দু’একদিন পরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সারাদেশ থেকে পাইকাররা আসছেন। ফলে বসন্ত দিবস ও ভালবাসা দিবসে ভালো দাম পাবেন ফুলচাষিরা।

ফুলক্ষেতে পরিচর্যা করতে করতে চাষি গোলাম রসুল বলেন, এখন দম ফেলার ফুসরত নেই। শেষ মুহূর্তে ক্ষেত পরিচর্যা করে ফুল ধরে রেখে বাজারে তুলতে হবে। ফুলের মান ভালো থাকলে ভালো দাম পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, করোনাভাইরাস ও আমফান ঝড় এই অঞ্চলের ফুল সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীরা। গতবছর বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে প্রায় ২৫ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়েছিল। এর আগের দুই বছর চাষিরা কোনো ফুলই বিক্রি করতে পারেনি। এ বছর আবহাওয়া ভালো হওয়ায় ফুল চাষের জমি যেমন বেড়েছে, তেমনি উৎপাদনও হয়েছে ভালো। একইসাথে বাজার পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় আশা করা হচ্ছে, বেচাকেনা গত বছরের দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।

যশোরের ঝিকরগাছার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ জানান, ঝিকরগাছার ৬৩০ হেক্টর জমিতে ৭২ প্রজাতির ফুল চাষ হয়ে থাকে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং যথা সময়ে শীত পড়ায় ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। পাশাপাশি পোকার আক্রমণও অনেক কম। এ কারণে ফুল বিক্রি করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //