চামড়া ব্যবসায় এবারও পুঁজি সংকট

চামড়া শিল্পের সংকট কাটাতে এবার কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য বৃদ্ধি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা। মূল্য বৃদ্ধির পরও হাসি নেই বরিশালের চামড়া ব্যবসায়ীদের মুখে।

তারা বলছেন, ‘ঢাকার ট্যানারিগুলোতে তাদের আগের কয়েক বছরের চামড়া বিক্রির লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। সেই টাকা না পাওয়ায় পুঁজি সংকটে আছেন তারা। তার উপর ট্যানারি মালিকদের থেকে মূল্য না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে তাদের। তাই এবারের ঈদেও হাতে গোনা দু-চারজন বাদে বাকি পাইকাররা চামড়া ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তারা এবার কোরবানিতে চামড়া ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সর্ববৃহৎ পাইকারি চামড়ার মোকাম ছিল বরিশাল নগরীর পদ্মাবতী এলাকায়। নগরী ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি জেলা ও উপজেলায় কোরবানি হওয়া পশুর চামড়া বিক্রি হতো এই পাইকারি বাজারে। এখান থেকে প্রক্রিয়াজাত করা চামড়া বিক্রি হতো ঢাকার ট্যানারিতে। তবে গেল চার বছরেই নগরীর পদ্মাবতী এলাকার সেই চিরচেনা রূপ হারিয়ে গেছে। পদ্মাবতীর চামড়া পট্টিতে এখন আর চমড়া প্রক্রিয়াজাত হয় না। পুরো এলাকাজুড়েই এখন চলছে গার্মেন্টস সামগ্রীর ব্যবসা। চামড়া ব্যবসায়ীরা এখন এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। অনেকে আবার চামড়া ব্যবসার বকেয়া আদায় করতে না পেরে দিনমজুরের কাজ করছেন। ধার-দেনায় জড়িয়ে পাওনাদারদের ভয়ে যেতে পারছেন না নিজ এলাকায়।

এমনই একজন চামড়া ব্যবসায়ী হানিফ সওদাগর। এক সময় তিনি পদ্মাবতীর পাইকারি চামড়ার আড়তে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পরে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় ঊলানিয়া বাজারে নিজেই চামড়ার ব্যবসা শুরু করেন। ধার-দেনা করে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন এই ব্যবসায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার কর্মচারী হিসেবেই ফিরতে হয়েছে পদ্মাবতীর চামড়ার আড়তে।

আলাপকালে হানিফ বলেন, ‘ধার-দেনা করে ট্যানারি মালিকদের লাখ লাখ টাকার চামড়া দিয়েছি; কিন্তু ট্যানারি মালিকরা মূল্য দিচ্ছেন না। এখনো ১৮ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে তাদের কাছে। সেই টাকা পাব কি-না নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। পুঁজি হারিয়ে এখন পথে বসেছি। সংসার চালাতে পারছি না। আমার মতো অনেক চামড়া ব্যবসায়ী এখন এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা বা কাজ করছেন। বর্তমানে শুধু চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বাচ্চু ভাই ও সহ-সাধারণ সম্পাদক নাসির ভাই ছাড়া আর কেউ এই ব্যবসায়ী টিকে নেই। তারাও লাখ লাখ টাকা পাবেন ট্যানারি মালিকদের কাছে। বকেয়া টাকার জন্য এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন তারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবারের ঈদে চামড়ার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এবারের কোরবানিতে নতুন করে চামড়ার ব্যবসায় কিছু টাকা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছি। পরিস্থিতি বুঝে সর্বোচ্চ ৪০০ থেকে ৫০০ পিস চামড়া কেনার পরিকল্পনা আছে। তবে সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, তাতেও লোকসানের শঙ্কা রয়েছে। বরিশালে সর্বোচ্চ ২০-৩৫ বর্গফুটের চামড়া পাওয়া যায়। একটি চামড়া ৫০০ টাকায় কেনার পর লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন ভাড়াসহ ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত আরও ৩০০ টাকা খরচ আছে। সব মিলিয়ে একটি চামড়ায় খরচ সর্বনিম্ন ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এরপর লাভের হিসাব।’

হানিফ বলেন, ‘২০১৬ সালে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়। এর পরই লোকসানের অজুহাতে বরিশালের চামড়া ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা আটকে দেয় ট্যানারি মালিকরা। গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ট্যানারি মালিকদের টাকা পরিশোধের জন্য চিঠি দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত বছর ট্যানারি মালিকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন সরাসরি ঢাকায় চামড়া বিক্রি করলে ৪০ টাকা করে দেবেন। এ জন্য অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া প্রক্রিয়া করে ঢাকায় নিয়ে যান; কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার পর ব্যবসায়ী কেঁদে ফিরেছেন।

ঘোষণা অনুযায়ী, তাদের মূল্য দেওয়া হয়নি। ৩০-৩৫ বর্গফুটের চামড়ার মূল্য ২০ টাকাও পাননি তারা। তাই এবার আর বাকিতে চামড়া বিক্রিতে রাজি নই। নগদ টাকায় চামড়া কিনে নগদ টাকায় ঢাকায় বিক্রি করে আসব।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর পদ্মাবতী এলাকা কেন্দ্রিক বরিশাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি রয়েছে। সমিতিতে মোট সদস্যের সংখ্যা ২৬ জন। এক সময় তারা সবাই চামড়ার ব্যবসা করতেন; কিন্তু এখন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুর রহমান শাহিন নিজেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন পদ্মাবতী এলাকায় গার্মেন্টস সামগ্রীর ব্যবসা করছেন।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুর রহমান শাহিন বলেন, ‘চামড়া ব্যবসা আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখন পুঁজি সংকটে ভুগছি। ট্যানারি মালিকদের কাছে আমি একাই ২২ লাখ টাকা পাব। আর সব ব্যবসায়ী মিলে দুই কোটির উপর টাকা পাবে; কিন্তু দেওয়ার কোনো নাম নেই। গত বছর আমার ২২ লাখ পাওনা টাকার মধ্যে থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। এর আগের বছর দিয়েছে মাত্র ৪০ হাজার। এ বছর টাকা পরিশোধের কোনো আলোচনাই নেই। তাই এবার দু-একজন ছাড়া আর কেউ চামড়া কিনবে না।’

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘সরকার চামড়ার মূল্য বৃদ্ধি করেছে ঠিক আছে। তবে প্রক্রিয়াজাত ছাড়া শুধু কাঁচা চামড়া কিনলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হতো। কেননা লবণের দাম বেশি। অনেক খরচ আছে প্রক্রিয়াজাতকরণে। আবার সরকার চামড়া ব্যবসায় ভুল জায়গায় লোন দিচ্ছে। তারা ট্যানারি মালিকদের লোন দিচ্ছে। এখানে আমাদের মতো পাইকারদের লোন দিলে তারা ব্যবসায় উৎসাহী হতেন। চামড়া ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পাইকার পর্যায়ে সরকারি প্রণোদনা জরুরি বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //