৯৩ বছর ধরে টানা কোরআন তেলাওয়াত চলছে যে মসজিদে

৯৩ বছর ধরে অবিরতভাবে কোরআন তেলাওয়াত চলছে টাঙ্গাইলের একটি মসজিদে। ব্যাপারটি বিস্ময়কর হলেও সত্য ও বাস্তব। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর এ মসজিদে ১৯২৯ সাল থেকে একটানা ২৪ ঘণ্টা কোরআন তেলাওয়াত চলছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি তেলাওয়াত। কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত নিয়োগপ্রাপ্ত হাফেজরা এই মসজিদে ধারাবাহিকভাবে কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।

ধনবাড়ীর বিস্ময়-জাগানিয়া এ মসজিদের নাম “নওয়াব শাহী জামে মসজিদ”। ৭০০ বছরের পুরনো এ মসজিদটি ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এ অঞ্চলে।

ইতিহাস বলছে, সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামে দুই ভাই ১৬ শতাব্দীতে ঐতিহ্যবাহী এক কক্ষ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সম্রাট আকবরের সময় এই দুই ভাই ধনবাড়ীর অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করার পর এ অঞ্চলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ও এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। 

এরপর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১৩৫ বছর আগে এ মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

সংস্কারের আগে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৩. ৭২ মিটার (৪৫ ফুট)। প্রস্থ ছিল ৪. ৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। সংস্কার করে মসজিদটি বর্গাকৃতির ও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মোগল স্থাপত্যের বৈ-সাদৃশ্যপূর্ণ করা হয়েছে। মোগল স্থাপত্য-রীতিতে তৈরি এই মসজিদের মেঝে আর দেয়াল কাঁচের টুকরো দিয়ে নকশাদার মোজাইক করা। মেঝেতে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। ভেতরের সব জায়গাতেই চীনামাটির টুকরো দ্বারা মোজাইক নকশায় অলংকৃত। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফুলের নকশা দৃশ্যমান। এত বছরে একটু ফাটল পর্যন্ত ধরেনি এই নকশায়। সংস্কারের কারণে প্রাচীনত্ব কিছুটা বিলীন হলেও মসজিদের সৌন্দর্য অনেকগুণ বেড়ে গেছে। মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য পূর্বদিকের বহু খাঁজে চিত্রিত খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ। আর উত্তর ও দক্ষিণে আরও তিনটি করে সর্বমোট নয়টি প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রায় ১০ কাঠা জায়গায় নির্মিত মসজিদটির চতুর্দিক থেকে ৪টি প্রবেশ পথ এবং ৯টি জানালা এবং ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রত্যেকটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মিহরাবটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। মসজিদের মেঝে ও দেয়াল কাঁচের টুকরো দিয়ে নকশা ও মোজাইক করা।

৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের মাথায় স্থাপিত ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে। মসজিদে ১৮টি হাড়িবাতি সংরক্ষিত রয়েছে, যেগুলো আগে নারিকেল তেলের মাধ্যমে আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। মোঘল আমলে ব্যবহৃত ৩টি ঝাড়বাতিও রয়েছে। সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। যেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। পূর্বদিকের ৩টি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিমের দেয়ালে ৩টি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটির অষ্টভুজাকারের দুই পাশে রয়েছে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান। এছাড়াও সেটিতে ফুলের রকমারি নকশা রয়েছে। অন্য দু’টি মিহরাবও বহু খাঁজবিশিষ্ট তবে কারুকার্যহীন খিলানযোগে গঠিত। প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর শান বাঁধানো ঘাটের বিশাল একটি দীঘি রয়েছে। তাতে মুসল্লিরা অজু করেন। তাছাড়াও মসজিদের আশপাশে সুপ্রশস্ত ও খোলামেলা অনেক জায়গা রয়েছে। যা দর্শনার্থীদের মনে বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তার ওয়াকফকৃত সম্পদের মাধ্যমে মসজিদ, পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসা ও ঈদগাহ পরিচালিত হয়।

নওয়াব শাহী জামে মসজিদটি দেখতে ও কোরআন তেলাওয়াত শুনতে এবং নামাজ পড়তে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বহু দর্শনার্থী আসছে। এই মসজিদটির ইমামের দায়িত্বে রয়েছেন হাফেজ মাওলানা ইদ্রিস হুসাইন। আর কোরআন তেলাওয়াত ও খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন পাঁচজন। এরা হলেন, হাফেজ মো. কামরুজ্জামান, হাফেজ আব্দুল ওয়ারেজ, হাফেজ আব্দুস সামাদ, হাফেজ মো. হেদায়েত ও হাফেজ আবু হানিফ।

মসজিদের খতিব হাফেজ মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘১৯২৭ সালে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এ মসজিদে সার্বক্ষণিক কোরআন তেলাওয়াত করার ব্যবস্থা করেন। এরপর ১৯২৯ সালে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। পরে মসজিদের একপাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তার মৃত্যুর পরও চলমান রয়েছে কোরআন তেলাওয়াত।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোরআন তেলাওয়াতের জন্য আমরা পাঁচজন হাফেজ দায়িত্বে আছি। নামাজের সময় ছাড়া এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয় না কোরআন তেলাওয়াত। টানা ৯৩ বছর ধরে অবিরত চলছে কোরআন তেলাওয়াত।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //