কুপ্রস্তাবে না, সহকর্মীর স্বামীকে শিবির বানানোর অভিযোগ দুই ওসির বিরুদ্ধে

রাজশাহীর দুই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন পুলিশেরই একজন নারী কর্মকর্তা। তার অভিযোগ, ওসির কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় তার স্বামীকে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে ফাঁসানো হয়েছে। দুই ওসির মধ্যে একজন পুলিশের এই নারী পরিদর্শকের সাবেক স্বামী। তার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।

বুধবার (২৫ মার্চ) রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে দুই ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগটি করেন ওই নারী পরিদর্শক। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর চারঘাটে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে সংযুক্তি হিসেবে কর্মরত আছেন। তার মূল কর্মস্থল ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার অভিযোগটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ খন্দকার গোলাম ফারুক সুপারিশ করেছেন।

অভিযোগ ওঠা দুই ওসি হলেন- আরএমপির বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ এবং দামকুড়া থানায় কর্মরত ওসি মাহবুব আলম। এদের মধ্যে মাহবুব আলম অভিযোগকারী নারী পুলিশ কর্মকর্তার সাবেক স্বামী। ২০১৮ সালে মাহবুবের সাথে হোসনে আরার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এরপর ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা আবার বিয়ে করেন। ওসি মাহবুবও পরে পুলিশে কর্মরত আরেক নারীকে বিয়ে করেন।

অভিযোগে ওই নারী পরিদর্শক উল্লেখ করেন, ‘২০১৩ সালে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব আলমের সাথে আমার বিয়ে হয়। মাহবুব আলম বর্তমানে রাজশাহী মহানগরের দামকুড়া থানার ওসি হিসেবে কর্মরত আছেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আমি নিরুপায় হয়ে ২০১৮ সালে মাহবুব আলমের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাই। এরপর থেকে মাহবুব আলম আমাকে তার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য বিভিন্নভাবে বিরক্ত করে। পরবর্তীতে আমার পারিবারিকভাবে রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানার ললিতাহার এলাকার আব্দুল ওদুদের ছেলে মাহবুব হুসাইনের সাথে বিয়ে হয় এবং আমি সুখে শান্তিতে বসবাস করছি।’

অভিযোগে ওই নারী উল্লেখ করেন, রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ রাজশাহীতে যোগদান করার পর আমার সাথে পরিচয় হলে আমি তাকে কথা প্রসঙ্গে আমার বিষয়টা জানাই। এরপর থেকে নিবারন চন্দ্র বর্মণ আমাকে বিভিন্ন সময় বিরক্ত করতে থাকেন। যেমন, আমাকে তার অনেক ভালো লাগে, আমি দেখতে অনেক আকর্ষণীয়, আমার মত একটা মেয়ে পেলে আর তার কিছুই লাগবে না ইত্যাদি। আমি বিষয়টা না বোঝার ভান করে তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি।

পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব আলম বোয়ালিয়া থানার ওসি তদন্ত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ মাহবুব আলমের বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করতেন এবং বলতেন ‘একই শহরে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে তুমি কি সংসার করতে পারবা? তুমি তো বিপদে পড়ে যাবা।’ এছাড়া পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব আলমও আমার বর্তমান স্বামী মাহবুব হুসাইনকে মতিহার থানায় ডেকে নিয়ে বিভিন্ন হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে বিয়ে করে তুমি ভালো থাকতে পারবে না। তারপর বলেছিলেন, ‘ওর সাথে মিশে তুমি আমার সাথে শত্রুতা তৈরী করো না।’

অভিযোগে ওই নারী আরো লিখেন, গত ১৬ মার্চ রাত দেড়টার সময় আমার স্বামী মাহবুব হুসাইন আমাকে ফোন করে বলে যে, বাসায় পুলিশ এসেছে। আমি আমার স্বামীর ফোন থেকে বোয়ালিয়া থানার ওসি (তদন্ত) লতিফের সাথে কথা বলি। তারা তখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ির বাসা থেকে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে পুনরায় এসে আমার স্বামীকে নিয়ে যায়।

আমি পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) লতিফকে ফোন করে বলি- তুমি কি ওকে (মাহবুব হুসাইন) নিতে গেছো? লতিফ জানায় হ্যাঁ নিতে গিয়েছি। এরপর থেকে আমি অসংখ্যবার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ এনং ওসি তদন্ত লতিফকে ফোন করি এটা জানার জন্য যে, তারা আমার স্বামীকে কেন নিয়ে গেছে? কিন্তু আমি পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হওয়া সত্বেও তারা আমার ফোন রিসিভি করেনি।

এরপর সকাল ৮ টা ১০ মিনিটের দিকে আমি বোয়ালিয়া থানায় আসি। ডিউটি অফিসার এএসআই চাঁদ সুলতানা আমাকে জানায় যে, আমার স্বামীকে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে আসা হয়েছে রাত ২ টা ৩০ মিনিটের পরে। ওই সময় আমি ডিউটি অফিসার এর সাথে এবং থানার অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের সাথে আলোচনা করে জানতে পারি আমার স্বামীর নামে তাদের কাছে কোনো রাজনৈতিক তথ্য নাই। আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে চাইলে ডিউটি অফিসার জানায় ওসি স্যারের নিষেধ আছে। সকাল অনুমানিক ৮ টা ৩০ মিনিটে ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় থানায় আসে এক মুচকি হেসে আমাকে বলে যে, ‘সেইতো দৌড়াইয়া আমার কাছে আসলা। কিন্তু সময়মতো আসো নাই, তখন তো আমাকে ভালো লাগে নাই। এরপর তিনি বললেন, ‘তোমার স্বামী তো শিবির করে।’ আমি বললাম, না স্যার ও কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত না।’ তখন তিনি বললেন, ‘পুলিশ কমিশনার স্যারের কাছে তোমার কথা বলে তিনি বললে তোমার স্বামীকে ছেড়ে দিবো।’

আমি বললাম, স্যার আমি কি আপনার সাথে কমিশনার স্যারের কাছে যাবো?’ নিবারণ স্যার বললেন, না তোমার যেতে হবে না। তখন আমি ডিউটি অফিসাবের রুমে অসহায়ের মত বসে থাকলাম। এরপর আনুমানিক বেলা একটার দিকে ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ থানায় ফিরলেন। আমি পিছনে পিছনে তার অফিস রুমে ঢুকলাম। তিনি বললেন, ‘তোমার স্বামীর নামে মামলা হবে।’ তখন আমি বললাম, ‘স্যার আমি কি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে পারবো?’ তিনি অনুমতি দিলেন। আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখি আমার স্বামীর মুখে হাতে আঘাতের চিহ্ন। আমি আমার স্বামীকে দেখে তার দুইটা মোবাইলের একটা ওসি স্যারের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে কোর্টে চলে আসি।

ওইদিন বিকেল ছয়টার দিকে আমার স্বামীসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের কোর্ট নিয়ে আসে। তখন জানতে পারি আমার স্বামীর নামে সন্ত্রাস দমন আইনের মামলা দিয়েছে এবং তার নামের পাশে শিবিরকর্মী লিখে দিয়েছে। অথচ আমার স্বামী কোনভাবেই জামাত-শিবিরে সাথে জড়িত না। মূলত আমার স্বামী কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই জড়িত নয়। কোনো দলীয় কমিটিতে আমার স্বামীর নাম কেউ দেখতে পারবে না। এরপর আমি জেলখানায় আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে গেলে আমার স্বামী আমাকে জানায় বোয়ালিয়া থানার এসআই মতিনসহ ওই টিমে থাকা অন্যান্য সদস্যরা শুধু আমার স্বামীকে শারীরিক নির্যাতন করেছে। এসআই মতিন আমার স্বামীকে বলেছে, ‘শালা মাহবুব স্যারের বউকে বিয়ে করার শখ হয়েছে। মাহাবুব স্যার তোর জীবন বরবাদ করে দিবে। তুই মনে রাখিস।’

ওই নারী পরিদর্শক আরো লিখেন, ‘আমার স্বামী রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নয়। আমি আমার স্বাামীকে নিয়ে সহজ স্বাভাবিক ও শান্তিময় জীবন-যাপন করছিলাম। ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ তার ব্যক্তিগত নোংরা উদ্দেশ্য আমার উপর প্রয়োগ করতে না পেরে এবং ওসি মাহবুব আলম আমার উপর পূর্ববর্তী আক্রোশ থেকে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে আমার স্বামীকে মিথ্যা বানোয়াট মামলায় চালান দিয়েছে। আমি পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে যেন হেয় প্রতিপন্ন হই সে জন্যই এই ধরনের কাজ করেছে। আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন নারী সদস্য। শুধু ব্যক্তিগত আক্রোশ বশত আমার এবং আমার স্বামীর উপর এই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ এবং ওসি মাহবুব আলমসহ আমার স্বামীকে যারা থানায় শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিনীত আবেদন করছি।’

অভিযোগের বিষয়ে ওসি মাহবুব আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে এই ধরনের ঘটনা সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, আমার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর থেকে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। সে আমাকে ফাঁসাতে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে। 

এ বিষয়ে ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ওই নারীর সাথে কোনো আপত্তিকর কথা হয়নি। তার স্বামীকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু স্বামীকে বাঁচাতে সে আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //