রাজা নবরঙ্গর আমলে কটিয়াদীতেই প্রথম ঢাকের হাটের সূচনা

ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে আজ বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) শুরু হলো সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। পূজা উপলক্ষে এবারো জমজমাট কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় পাঁচশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। 

তবে এবার করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে ঢাকের হাটটি বসেছে ষষ্ঠীপূজার দুইদিন আগেই। চলবে ষষ্ঠীর দিন দুপুর পর্যন্ত।

গতকাল বুধবার (২১ অক্টোবর) কটিয়াদীর পুরান বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারো ঢাকিদের সরব উপস্থিতি। তবে করোনার কারণে দূর-দূরান্ত থেকে আসা ঢাকির সংখ্যা তুলনামূলক কম। যারা এসেছেন তাদের মধ্যে ঢাকার বিক্রমপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে আসা ঢাকির সংখ্যাই বেশি।

হাটের নাম ‘ঢাকের হাট’ হলেও এখানে বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচার কারবার হয় না। মূলত এ হাটে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের বাদকরা টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন পূজা আয়োজকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। বাদকরা তাদের বাদ্যযন্ত্র বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বাজিয়ে বায়নাকারীদের আকৃষ্ট করেই পূজার দিনগুলোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। বেশিরভাগ ঢাকিই বংশ পরম্পরায় এ হাটে ঢাক-ঢোল নিয়ে উপস্থিত হন। হাটে ঢাক-ঢোল ছাড়াও বাঁশি, সানাই, করতাল, খঞ্জনি, মন্দিরা, কাঁশি, ঝনঝনিসহ নানা জাতের বাদ্যযন্ত্রও বায়না করা হয়।


বাদকরা জানান, প্রতিবার দলগতভাবেই বিভিন্ন পূজা আয়োজকদের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। তবে এবারের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। করোনাভাইরাসের প্রভাবে যাদের সাথে দরদামে মিলবে, তাদের মণ্ডপেই বাজনা বাজাবেন। প্রতিবার ১০ হাজার থেকে লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায় চুক্তিমূল্য। তবে এবারের পূজায় সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই যেখানে মোটামুটি পোষাবে, সেখানের মণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে মনস্থির করেছেন তারা।

শ্যামল দাস (৬৫) প্রতিবার নরংসিদীর কোনো না কোনো দলের সাথে আসেন। তবে এবার এসেছেন একা। তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতেই এখানে এসেছি। গত ৪০ বছর ধরে এ হাটে ভালো বায়নায় চুক্তি পেয়েছি। আশা করছি, আজকের মধ্যেই কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাবো। তবে এবার যেহেতু একা ৮-১০ হাজার পেলেও যেকোনো জায়গার মণ্ডপে অংশ নেবো।’

ঢাকিসহ বিভিন্ন বাদ্যের একটি দল ভাড়া নিতে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা থেকে এসেছেন সুকুমার পন্ডিত। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে হাটে ঘুরছি। বিভিন্ন বাদকের সাথে কথাও হয়েছে। বাদ্যযন্ত্র ও বাদকদের পরখ করা হয়েছে। প্রতিবছরই এখান থেকে বাদকদলের সাথে চুক্তির মাধ্যমে তাদের নিয়ে যাই। তাই এবারো এসেছি। বিক্রমপুরের একটি দলকে পছন্দ হয়েছে, দাম-দর ঠিক থাকলে চুক্তি করবো।’

জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দির প্রথম ভাগে রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলে কটিয়াদীতে প্রথম ঢাকের হাটের সূচনা হয়। তিনি ওই সময় রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। একবার তিনি পূজার প্রয়োজনে সেরা ঢাকির সন্ধানে বিক্রমপুর পরগনায় বার্তা পাঠান। তখন নৌপথে বহু ঢাকি কটিয়াদী আসেন। রাজা নিজে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন। সেই থেকেই প্রচলন শুরু এ ঢাকের হাটের।

হাটের আয়োজকদের পক্ষে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, কটিয়াদী উপজেলা শাখার সভাপতি বেনী মাধব ঘোষ বলেন, ‘এ হাটে প্রতিবছরই প্রায় পাঁচশ বাদকদল দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে অংশ নেন। কটিয়াদি পুরান বাজারে এ হাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আয়োজক হিসেবে বাদকদল ও যারা বায়না করবে, তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে থাকি। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে বাদকদের উপস্থিতি অনেকটাই কম। আবার হাটে আসা সব বাদকই চুক্তিবদ্ধ হতে পারে না। তখন তাদেরকে গাড়িভাড়া দিয়ে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //