ভাইয়ের দাফন শেষে হাওর পরিদর্শনে স্মৃতিকাতর রাষ্ট্রপতি

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৬ জুলাই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছোট ভাই মো. আবদুল হাই মারা গেছেন। 

রবিবার (১৯ জুলাই) বিকালে হেলিকপটারযোগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মিঠামইন হেলিপ্যাডে নেমে সেখানেই গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। পরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মিঠামইন সদর থেকে তার বসতভিটা কামালপুরের বাড়িতে যান।

সেখানে সর্বশেষ নামাজে জানাজায় অংশ নিয়ে ছোট ভাই তার সহকারী একান্ত সচিব আবদুল হাইকে বাবা-মার কবরের পাশে সমাহিত করেন।

মোনাজাতের সময় লোনা জল রাষ্ট্রপতির দু‘চোখ প্লাবিত করে। তার সেই কান্না জানাজায় অংশ নেয়া অন্যান্যদেরকেও আবেগাপ্লুত করে।

এরপর তার আবেগ-ভালবাসার জন্মভিটায় সদ্য নির্মিত একটি কক্ষে অবস্থান নেন রাষ্ট্রপতি। সেখানে তার সফর সঙ্গী ছাড়া অন্য সবার যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। আপনজনদের সাথে ছোট ভাই আবদুল হাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।

সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত আবদুল হাই সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান সময়ের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার মতো মানুষ ছিল না আবদুল হাই। তাই আমি ডেপুটি স্পীকার হওয়ার পরই নির্লোভ সাদা মনের মানুষ আবদুল হাইকে আমার সাথে রাখি।

বয়সে আমার অনেক ছোট আবদুল হাইকে সব-সময় বাবার আদরে আগলে রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস সে ইন্ডিয়ার বালাট ক্যাম্পে আমার সাথে ছিল। রাজনৈতিক বাস্তবতা বড় কঠিন ও রুঢ়। তাই আমি সব সময় তার প্রতি বিশেষ নজরদারি করেছি।

এসব কথা বলার পর গভীর রাতে তিনি ঘুমাতে যান। সোমবার (২০ জুলাই) একটু বেলা করে বিছানা ছাড়েন। রাষ্ট্রপতি নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার (২০ জুলাই) বিকেলেই মিঠামইন ত্যাগ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা।

কিন্তু হাওরের প্রতি নাড়ির টান আর গভীর ভালোবাসা তার মন সায় দেয় না বঙ্গভবনে ফিরে যেতে। তাই তার ঐকান্তিক ইচ্ছার কাছে কর্মসূচি পরিবর্তন হয়। তিনি আরো একদিন জন্মভিটা কামালপুর থাকবেন।

কারণ স্বাধীনতার দীর্ঘ তিন যুগ চির অবহেলিত, চির বঞ্চিত হাওর এলাকা বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। হাওর যেন হয়ে উঠেছে বিশ্বের উন্নত দেশের কোনো সমুদ্রের মাঝে নির্মিত স্বপ্নের শহর।


 জলমগ্ন সদ্য যৌবনা তরুণীর মতো অসাধারণ রূপে সেজেছে রাষ্ট্রপতির প্রিয় হাওর। সেই অনিন্দ্য সুন্দর হাওর নিজ চোখে অবলোকন না করে তিনি (রাষ্ট্রপতি) তো আর ফিরে যেতে পারেন না। তাই হাওরের গভীর ভালোবাসা থেকে হাওর দর্শনে তিনি একদিন কর্মসূচি বাড়িয়ে থেকে গেলেন মঙ্গলবার (২১ জুলাই) পর্যন্ত।

সোমবার (২০ জুলাই) বিকালে তিনি চোখ জুড়ানো মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়ক পরিদর্শনে বের হন। তিনি পুলিশের গাড়িতে আর তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মো. শামীমুজ্জামানসহ অন্যরা অটোরিকশায় যান।

সড়কের দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। উত্তাল ঢেউয়ের আঘাত আর ইঞ্জিনচালিত ছোট ছোট নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরার স্বপ্নিল ছবি দেখে রাষ্ট্রপতিসহ তার সফর সঙ্গীরা হতবাক হন। অনেকেই আশ্চর্য-আনন্দে বিহব্বল। দেশে এমন সুন্দর এলাকা রয়েছে! নিজ চোখে না দেখলে তা তাদের বিশ্বাসে ছিল না।

ইটনায় পৌঁছে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বৃষ্টির মধ্যে আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রপতি হাজির হন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে। রাষ্ট্রপতি আসার খবরে বৃষ্টি উপেক্ষা সেখানে জড়ো হন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

ইটনা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান জানান, মহামান্য রাষ্ট্রপতি দীর্ঘক্ষণ স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, করোনা পরিস্থিতি, এলাকার সার্বিক পরিস্থিতিসহ হাওরের সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলেন।

পরে মঙ্গলবার (২১ জুলাই) সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে বাড়ির বাংলা ঘরে মধ্যে বসেই পারিবাবিক পরিবেশে ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন, ‘৭০ এর নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ, ‘৭৫ এর রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও সময়পোযোগী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা কথা ও স্মৃতিচারণ করেন।

দুপুরে খাবার পর দুপুর আড়াইটায় পারিবারিক গোরস্থানে সদ্য প্রয়াত ছোট ভাই আবদুল হাই মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের কবর জিয়ারত করেন। মোনাজাতের পর সদলবলে হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বিকেল তিনটার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া বলেন, হাওরের প্রতি রাষ্ট্রপতির হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা রয়েছে। তার শিশুকাল, কৈশোর এবং রাজনীতির উত্থান এ হাওর জনপদ থেকে হয়েছে। তাই তিনি এখানে এলে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। এবার তিনি একদিন তার কর্মসূুচি বাড়িয়েছেন।


রাষ্ট্রপতির প্রেস-সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, হাওর এখন আর আগের হাওর নেই। বর্ষা হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য, বিশেষ করে বিশাল জলরাশির মধ্যে ভাসমান সড়ক, ভাসমান বিশাল ব্রীজ যেন সুইডেন কিংবা উন্নত কোনো দেশের অভাবনীয় সৌন্দর্যেও কথা বলে দেয়। আর এসব উন্নয়নের নেপথ্য কারিগর মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাই তিনি এখানে এলে গভীর মমতায় আবদ্ধ হয়ে সবকিছু ভুলে যান।

রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে কিশোরগঞ্জ- ৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিক জানান, ‘৭০ সাল থেকে আব্বা এখান থেকে ৭ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। সব-সময় বিরোধী দলে থাকায় হাওর এলাকা উন্নয়নে পিছিয়ে ছিল।

বর্তমান সরকারের আমলে হাওরের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। আর এই উন্নয়নের পেছনে ত্যাগ, শ্রম. মেধা, পরিশ্রম সবকিছুই মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের। হাওর এখন দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য প্রধান ও  অন্যতম স্থান।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বাবার পথ অনুসরণ করে আমি যেন হাওরের উন্নয়ন করতে পারি তার জন্য সকলের দোয়া চাই। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //