ফয়সাল শামীম, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০, ১২:২৪ পিএম
আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২০, ০৫:২৯ পিএম
একে একে বেরিয়ে আসছে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের আরডিসি নাজিম উদ্দিনের অপকর্মের নানা কাহিনী।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ড দেয়ার মতোই একই কায়দায় মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নির্যাতন ও হয়রানি করে আসছেন নাজিম উদ্দিন। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে ভুক্তভোগী নির্যাতিতরা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে থাকেন।
নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতন করে ওই রাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন। একই কায়দায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ মানুষকে নানা অজুহাতে ধরে এনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল ও পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন বেশ কয়েকটি। নির্যাতিত এসব মানুষ তার এসব অপকর্মের শাস্তিসহ নিজেদের প্রতি সুবিচার চান সরকারের কাছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের পঞ্চায়েত পাড়ার কৃষক খালেকুজ্জামানের বাড়িতে গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে তাণ্ডব চালান নাজিম উদ্দিন। ওই ইউনিয়নের দেবীকুড়া নামক বিল নিয়ে দ্বন্দের জেরে প্রতিপক্ষের যোগসাজশে খালেকুজ্জামানের বাড়ির দরজা, জানালা ভেঙে তাকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন। ওই সময় তাদের বাধা দিতে গেলে তার স্ত্রী, সন্তান ও নাতিসহ পার্শ্ববর্তী অনেককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করাসহ লাঠিপেটা করেন।
কৃষক খালেকুজ্জামান
পরে খালেকুজ্জামানকে গাড়িতে তুলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যান। পথে খালিকের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় জেলে দেয়ার হুমকি দেন নাজিম। খালিক টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মধ্যরাতে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের নিচতলায় একটি রুমে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। বর্তমানে জামিনে রয়েছেন তিনি।
খালেকুজ্জামান বলেন, ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা সময় হঠাৎ করে বাড়ির প্রত্যেকটি দরজার মধ্যে লাথি দেয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে আমার ঘরের দরজা ভেঙে আমাকে ঘর থেকে বের করে আনে। আমাকে বাইরে নিয়ে আসার পর আমি আরডিসি নাজিম উদ্দিনের কাছে জানতে চাই, এতো পুলিশ নিয়ে এসেছেন আমার অপরাধ কী। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলে একে অ্যারেস্ট করো। তারপর দুই বিজিবি সদস্য আমার দুহাত দুই দিক থেকে ধরে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে তোলার পর আমার মাথায় যে টুপি ছিল সেটাও খুলে ফেলে দেয়। এরপর অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আমাকে বলে, তোমার কাছে দুই লাখ টাকা আছে। যদি টাকা থাকে দাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাই। তখন আমি বললাম যে আমি টাকা কোথায় পাবো। আমার তো কোনো টাকা পয়সা নাই, গরিব মানুষ। তারপর ডিসি অফিসের নিচ তালায় আমাকে নিয়ে গিয়ে ওখানে একটি রুমে বসিয়ে বলা হয় তোমাকে ৬ মাসের জেল দেয়া হয়েছে। কোন প্রধানমন্ত্রী তোমাকে বাঁচায় দেখা যাবে। এখন আমার কথা হলো আমি এর ন্যায় বিচার চাই সরকারের কাছে।
খালেকুজ্জামানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তার পরিবারের সদস্যদেরকেও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। সে নির্যাতনের বর্ণনাও দেন তার স্ত্রী, নাতিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে আরডিসি নাজিম উদ্দিনের হাতে নির্যাতিত বিশ্বনাথের স্ত্রী, সন্তান ও তার ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে এসে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। কিছুদিন আগে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের একটি জলমহাল ইজারার ঘটনায় মৎস্যজীবী বিশ্বনাথকে একই কায়দায় মধ্যরাতে বাড়িতে গিয়ে ঘর থেকে বের করে কিল-ঘুষি মেরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে এসে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন নাজিম। টাকা দিতে না পারায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিশ্বনাথ জেলে থাকলেও এখন পর্যন্ত ওই মামলার কোনো কপি হাতে পাননি বিশ্বনাথের পরিবার।
নির্যাতনের শিকার বিশ্বনাথের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা
বিশ্বনাথের স্ত্রী পারো বালা দাস জানান, আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে মারপিট করে জেলে দিয়েছে। আমার দুইটি ছোট সন্তান নিয়ে তাদের পা ধরলেও তারা ছেড়ে দেননি। এমনকি আমার ছোট ছোট বাচ্চা দুইটিকেও লাথি ফেলে দিয়েছে এই ম্যাজিস্ট্রেট। আমাকে গালি দিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেছে। তারা আমার স্বামীকে ছেড়ে দেননি। তখন আমাকে বুট জুতা দিয়ে লাথি মারেন। প্রতিবেশীরা আসায় তাদেরকেও মারধর করেছে। আমি গরিব মানুষ কোথায় যাবো। আমার স্বামীকে ছেড়ে না দিলে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে কী খাব। আমার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হোক।
এ ব্যাপারে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শফিউল আলম শফি জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে ভিতরবন্দ ইউনিয়নে অনেক সাধারণ মানুষকে এভাবে হয়রানি করেছে আরডিসি নাজিম উদ্দিন। এসব ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করেছেন তিনি।
জেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, আরডিসি নাজিম উদ্দিন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যোগদান করেন ২৭ নভেম্বর ২০১৯ সালে। রাজস্ব, এলএ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আরএম শাখার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যোগদানের পর থেকেই জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে বিভিন্ন অপকর্ম শুরু করেন নাজিম উদ্দিন।
এছাড়া কক্সবাজার সদর উপজেলায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় তাকে সেখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছিল। সে সময় কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার মোহাম্মদ আলী ওরফে নকু মাঝি (৬২) নামের এক বৃদ্ধকে শারীরিক নির্যাতন করেন তিনি। পরবর্তীতে ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
অন্যদিকে শুধু প্রত্যাহার নয়, জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন করেছে ছাত্র, যুব সমাজ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এদিকে সাংবাদিক আরিফকে নির্যাতনের ঘটনায় সোমবার জেলা প্রশাসনের আরডিসি নাজিম উদ্দিনসহ দুই সহকারী কমিশনারকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার পরিবর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh