খনা: সত্যাশ্রয়ী এক নির্ভীক প্রাণ

‘যদি হয় চৈত্রে বৃষ্টি-
তবে হবে ধানের সৃষ্টি’
‘তেলা মাথায় ঢালো তেল
শুকনো মাথায় ভাঙ্গো বেল’
‘আলো হাওয়া বেঁধো না
রোগে শোকে মোরো না’

লোকমুখে প্রচলিত এমন অজস্র খনার বচন ছড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে, লোকালয়-জনপদে। শত শত বছর ধরে বাংলার প্রান্তিক জনগণের কাছে এই বচনগুলো আদৃত হয়ে আসছে, যা তাদের লোকজ জীবন তথা সামাজিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। খনার এই বুদ্ধিদীপ্ত বচনগুলো কৃষিজীবী প্রান্তিক মানুষের ভাষায় উচ্চারিত ছন্দময় সহজবোধ্য বচন-যা কৃষিনির্ভর জনপদের মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।

মৃত্তিকার সোঁদাগন্ধজাত খনার এই বচনগুলো প্রাচীন বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এবং যৌথ পারিবারিক বন্ধনের কথা বলে। খনার এই প্রচলিত বচনগুলো আবহমান বাংলার সমৃদ্ধ লোকাচার এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরার এক অনবদ্য ঐতিহাসিক দর্পণ, যা আদি বাংলার যূথবদ্ধ গ্রামীণ জীবন এবং হারানো ঐতিহ্য বৈভবের গর্বিত অংশীদার।

ধারণা করা হয় ৮ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে খনার এই বচনগুলো লোকমুখে প্রচার লাভ করে। খনা ছিলেন স্বশিক্ষিত একজন বিদুষী রমণী। জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা ছাড়াও বাংলার কৃষিভিত্তিক জীবন যাপন এবং কাদা জল পলিমাটি তথা জলবায়ু পর্যবেক্ষণ এবং পরিবেশ সংক্রান্ত উপলব্ধিজাত সিদ্ধান্তের এক সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন এই বিদুষী রমণী।

আধুনিকতা এবং নগরায়ণের নামে প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন করে দিয়ে আধুনিক মানুষ নিজেদেরই প্রতিনিয়ত রিক্ত নিঃস্ব করে চলেছে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ধসে যাচ্ছে আমাদের মানবিকতা এবং বোধের পৃথিবী। সংকীর্ণ ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দুর্বিষহ নাগরিক জীবন। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির আশীর্বাদ আলো-হাওয়া-জল, বৃক্ষরাজি, শস্য প্রান্তরের সুফলতা থেকে। জীবন হয়ে উঠেছে কৃত্রিম এবং অন্তসারশূন্য। আর এই অস্থির অভিশপ্ত সময়েই খনার বচন আরও তাৎপর্যময়, প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ খনার দর্শন বৃহত্তর প্রাণ-প্রকৃতির কল্যাণের কথা বলে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় মেলবন্ধনের কথা বলে। এখানে বিচ্ছিন্নতা বোধের বিষাদময়তা নেই, যার দেখা মেলে বিদ্যমান নগর সভ্যতায়। বরং খনার দর্শন আবহমান বাংলায় চর্চিত যূথবদ্ধ সংস্কৃতির সুরেলা ঐকতানকেই তুলে ধরে সামনে, যা কিনা প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ লোকাচার ও সাংস্কৃতিক পরম্পরার এক অনবদ্য দলিল। 

খনার যাপিত জীবনের এই আদর্শকে এখনকার প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের লক্ষ্যেই গত ১৩ এপ্রিল ভোর থেকে খনার মেলার আয়োজন করে মঙ্গলঘর পরিসর, আঙ্গোরোয়া, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা। বরেণ্য গীতিকবি এবং গণসংগীত শিল্পী কফিল আহমেদের দীর্ঘদিনের ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আয়োজকের ভূমিকায় এগিয়ে আসেন বদরুন নুর চৌধুরী লিপন, আবুল কালাম আল আজাদসহ আরও অনেকে। চৈত্র সংক্রান্তির সূর্যোদয় থেকে পহেলা বৈশাখ ১৪৩১-এর সূর্যোদয় পর্যন্ত দিনরাতব্যাপী এই খনার মেলার আয়োজন করা হয় প্রথমবারের মতো। রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক শিল্পী লেখক বুদ্ধিজীবীর আগমনে মেলা যেমন বর্ণিল হয়ে ওঠে, তেমনি স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং দূর-দূরান্ত থেকে আগত কামার কুমারের কৃষিজাত জিনিসপত্রের সমাহার মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। মেলায় আগত বাউল এবং লোকজ শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত পালা গান, আড্ডা-আলোচনা, পুঁথি পাঠ এক অভূতপূর্ব আনন্দময় পরিবেশের জন্ম দেয়-যার মধ্যে দিয়ে আয়োজকেরা তুলে ধরতে প্রয়াসী হন বিদুষী খনার সৃজনশীল এবং বুদ্ধিদীপ্ততার ঐতিহাসিক আখ্যান। তথা শাসক শ্রেণি এবং ক্ষমতা কাঠামোর বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে আপসহীন এক নারীর সত্যের পক্ষে অবিচল থেকে জীবন উৎসর্গ করার মতো অদম্য সংগ্রামের এক চিরন্তন বীরত্বগাথা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //