লোকায়ন: খেটে খাওয়া মানুষের ঐতিহ্যের জাদুঘর

ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে অকচা গ্রাম। সেখানেই নৈসর্গিক পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যতিক্রমী এক সংগ্রহশালা, যা মোটেও অন্য দশটা জাদুঘরের মতো নয়। লোকজ সংস্কৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামে ব্যবহৃত উপকরণভিত্তিক এই জাদুঘর লোকমানুষের জন্য। তাই এর নামকরণ হয়েছে লোকায়ন। মেহনতি মানুষের শতাব্দীর পর শতাব্দীর জীবন-যাপনের যুদ্ধ, উপকরণ ও বৈচিত্র্যের চেতনাকে ধারণ করেই ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্যতিক্রমী এই জাদুঘরটি।

এর উদ্যোক্তা মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। এখানে খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত আর ঘামে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যই স্থান পেয়েছে বেশি। কৃষক-খামারি, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, দিনমজুর তথা সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত কী নেই এখানে?

জাদুঘরটিকে কয়েকটি গ্যালারিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- নদী, আঞ্চলিক ভাষা, সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, মিউজিক, 

তৃণমূল লোকজ ও মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি। রয়েছে রবীন্দ্র মঞ্চ ও আপাং কটেজ। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। চারদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা বিশাল চত্বর। রয়েছে কয়েকশ প্রজাতির ফল-ঔষধি গাছ। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বসার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচা। চেয়ার ও টেবিল তৈরি করা হয়েছে নানা গাছের গুঁড়ি দিয়ে। গ্রামীণ পরিবেশ ও পাখপাখালির আপ্যায়নের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। পাখির কলকাকলি মনকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। জাদুঘরে বেড়াতে আসা শিশুদের বিনোদনের জন্য বসানো হয়েছে দোলনা, চরকি, ঢেঁকিসহ নানা ধরনের খেলনা। প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে লোকায়নের উদ্যোক্তা নিজেই বেড়াতে আসা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি প্রদর্শন করা হয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র।

ঈদের ছুটিতে জাদুঘরে ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম আহমেদ বলেন, বিশ্বে অনেক জাদুঘর আছে। কিন্তু সেগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষের ইতিহাস পর্দার আড়ালে রাখা হয়েছে। এই দিক থেকে এই জাদুঘরে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপন ও সংগ্রামের ইতিহাস ও নিদর্শন তুলে ধরে প্রশংসনীয় কাজ করা হয়েছে।

নদী গ্যালারিতে থরে থরে সাজানো কাচের বোতল। বোতলের ভেতর পানি। কোনোটা বঙ্গোপসাগরের, তো কোনোটা মর্মর সাগরের, কোনোটা পদ্মা, মেঘনা, যমুনার, তো কোনোটা টেমস বা টাফের। প্রতিটি বোতলের গায়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় আছে নদী বা সাগরের নাম, পানি সরবরাহকারীর নাম, পানি সংগ্রহের স্থান ও তারিখ। ‘লোকায়ন জীববৈচিত্র্য জাদুঘর’ নামে প্রতিষ্ঠানটিতে শুধু নদ-নদীর পানিই নয়, সাত মহাসাগরের বালুও সংরক্ষিত আছে। নদী গ্যালারিটি ২০১৬ সালে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো নদীর পানি গ্যালারিতে সংরক্ষণ আছে। সম্প্রতি যে সব নদী হারিয়ে যাচ্ছে, তারও পানি থেকে যাচ্ছে এই নদী গ্যালারিতে। তা ছাড়া নদীভিত্তিক বিভিন্ন পেশা-বৃত্তিনির্ভর উপকরণ, বাংলাদেশের নদ-নদীর তালিকা ও সে সংক্রান্ত তথ্য, নৌকা, নদীভিত্তিক উৎসব, মৎস্য, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা তথ্য এই গ্যালারিতে উপস্থাপিত। 

সাঁওতাল ও ওঁরাওদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, বাসস্থান ও পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, পেশা, উৎসব, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের বিভিন্ন উপকরণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গ্যালারিটি প্রতিষ্ঠিত। সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও এ গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়েছে।

তৃণমূল লোকজ গ্যলারিতে রয়েছে নানা কৃষিজ উপকরণ, ভেষজ এবং সংস্কারযুক্ত চিকিৎসা উপকরণ, বিভিন্ন কাল ও সময়ের মুদ্রা/কাগুজে নোট, অলংকার, ধর্মীয়/মাঙ্গলিক উপকরণ, ক্রীড়া/বিনোদন উপকরণ, গৃহ/বাসস্থান/গৃহস্থালি উপকরণ, বৈবাহিক উপকরণ, মৃৎশিল্প, দলিল/চিঠিপত্র/নথিপত্র, লোকশিল্প ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্ব, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্ব এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ পর্বে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি উপস্থাপনা বিস্তৃত। এ ছাড়া এ গ্যালারির দোতলায় একটি আধুনিক মিলনায়তন, মুক্ত মঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সমৃদ্ধ অডিও-ভিজ্যুয়াল লাইব্রেরি এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র নিয়মিত প্রদর্শন হয়।

জাদুঘরের সংগ্রহে লাঙল-জোয়াল, মই, ফলা, নিড়ানি, দা, কাস্তে, খুন্তি, মাথাল, ধান রাখার ডুবি, কৃষকের ক্ষেতের ইঁদুর মারার জন্য নানা রকমের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘণ্টা, মুখে দেওয়া টোনা, ডাল ভাঙার জাঁতা, ঢেঁকি, ছাম-গাইন, হাতুড়ি, শাবল, কোদাল, কুঠার, কামারের হাপর, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, কুয়ো থেকে বালতি তোলার কাঁটা, মাটির সানকি, বাসন-কোসন থেকে শুরু করে তরবারি, ঢাল, সড়কি, তীর-ধনুক, বল্লমও বাদ যায়নি। বলতে গেলে পুরো বাংলাদেশের লোকজ জীবনযাত্রাই তুলে ধরার চেষ্টা রয়েছে জাদুঘরটিতে। 

উদ্যোক্তা মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, লোকায়ন কোনো আভিধানিক শব্দ নয়। লোকজ, সংস্কৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামে ব্যবহৃত উপকরণভিত্তিক ওই জাদুঘরটি যেহেতু লোকমানুষের জন্য, তাই এর নামকরণ হয়েছে লোকায়ন। তিনি আরও বলেন, দেশ-বিদেশের জাদুঘরগুলোর অন্তরালে রয়ে গেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামের কথা। সংগ্রামী সব মানুষের জীবনগাথা চিরজাগ্রত রাখতেই লোকায়নের প্রচেষ্টা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //