যে গানটি ছাড়া অসম্পূর্ণ বাঙালির ঈদ

`ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।'

বাঙালি মুসলিমদের ঈদ উৎসবের একটি অপরিহার্য অংশ হলো এই কালজয়ী গানটি। ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনে, রেডিওতে বাজতে শুরু করে এই গানটি। এ গান ছাড়া রমজানের ঈদ আমাদের অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 

জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদের অনুরোধে এটি রচনা করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৩১ সালের ২৫ মে, এই গানটি প্রথমবার রেকর্ড করা হয়। গানটির সুরকারও ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই।

বাংলা ভাষায়ও যে চমৎকার গজল লেখা যায়, সেটা বোধহয় জাতীয় কবি নজরুলের আগে আর কেউ এভাবে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেননি।

কলকাতার রাস্তা দিয়ে এক রাতে পান চিবিয়ে গুন গুন করতে করতে নজরুল যখন ফিরছিলেন নিজের ঘরে, পথ আগলে দাঁড়ান কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। আবদারের সুরে নজরুলের কাছে একটি গজল চাইলেন। শ্যামাসংগীতের রমরমা সময়ে যখন কেউ গজলের কথা ভাবতেও পারছে না, সেখানে আব্বাসের এমন আবদার ফেলে দেননি নজরুল।

এক বসায় গান লিখে ফেলার প্রতিভা ও বাতিক দুটিই নজরুলের ছিল। গান লেখা হলে গ্রামফোনের ইনচার্জ ভগবতী বাবুকে ধরে রেকর্ড করাতে হবে। এই রেকর্ডিং করতে চার দিন সময় লাগলেও রেকর্ডিংয়ে রাজি করাতে ভগবতী বাবুর পেছনে আব্বাসকে দৌড়াতে হয়েছে মাসের পর মাস।

ঈদের বাজারে যখন নতুন এ গান মুক্তি পেল, আব্বাস তখন নিজের গ্রামের বাড়ি। ঈদের ছুটি কাটিয়ে যখন কলকাতা পা রাখেন, শুনতে পান আশপাশের গানের দোকান ও মানুষের মুখে মুখে বাজছে গানটি। আব্বাস অবাক আর এই তো শুরু নতুন এক যুগের। এই গান যেমনি বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে, ঈদের আবেগের সঙ্গে আজীবনের জন্য যুক্ত হয়ে গেছে, একইভাবে এই গানের সূত্র ধরে বাংলা গজলের এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল।

নজরুলের লেখা একের পর এক বাংলা গজল বাঙালির আবেগের অঙ্গ হয়ে উঠেছে আর সেই সব গজলের আদি পিতা নজরুলের লেখা ও আব্বাসের গাওয়া এই গান। গানের প্রতিটি লাইন ও শব্দ ইসলামের মাহাত্ম্য ও রমজানের শিক্ষাকে নির্দেশ করে। আব্বাস কণ্ঠে যখন বাজছিল ‘দে জাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ’ তখনই বোঝা যায়, ঈদ মানে শুধু নিজের খুশি নয়, সারা জাহানের জন্য নিজের সাধ্যমতো বিলিয়ে দিয়ে তার মাঝে আনন্দ খোঁজার নামই ঈদ।

আবার ধর্মের জায়গা থেকে যখন ভ্রাতৃত্বের জয়গান গেয়ে যখন বলা হয়, ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে/তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ’; তখন সহজেই বোঝা যায়, ঈদ আর কিছু না, সারা মাসের সংযমের মাধ্যমে নিজের ভেতরের সব আহাম্মকি ও অহংকারকে ধুয়ে-মুছে নতুন উদ্যমে মানবতার জয়গান গেয়ে জীবন শুরু করার সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। আর ইসলাম মানে যে শান্তি ও প্রেম–গানের প্রতিটি কলিতে, নজরুলের প্রতিটি বাণীতে তা বারবার ফুটে উঠেছে।

বাঙালির কাছে ঈদ মানে শুধু ধর্মীয় উদ্‌যাপন নয়; বরং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এ গান মিশে গিয়ে ঈদ হয়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার এক বিশাল নিদর্শন। এ গান যেমনি সাম্প্রদায়িকতার বাঁধ ভেঙে ঈদকে করে তুলেছে সার্বজনীন, তেমনি ‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/সেই গরিব ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ’ কলির মাধ্যমে বরাবরের মতো মানবতার ডাকের মাধ্যমে ধর্মশিক্ষা ও আচারের দিকটির মূল উদ্দেশ্যও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নজরুল ইসলাম।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //