জয় বাংলা স্টিকারে স্বাধীনতার মঞ্চে রকিবুল হাসান

জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এএসএম রকিবুল হাসান। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে নয়, মাঠে ব্যাট হাতে লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন তিনি। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো খেলাধুলাতেও যারপরনাই অবহেলিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বঞ্চনার শিকার হয়ে টেস্ট খেলার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন যে অধরাই থেকে যাবে, সে সময় এমন ভাবনা ছিল রকিবুল হাসানের। যদিও অনেকটা হঠাৎ করেই জানতে পারেন কমনওয়েলথ একাদশের বিপক্ষে পাকিস্তান দলে ডাক পেয়েছেন তিনি। 

ম্যাচের আগের দিন দল থেকে দেওয়া গ্রে নিকোলসের ব্যাটে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ার মার্কাসহ স্টিকার। রকিবুল বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারেননি। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তলোয়ার প্রতীক নয়, মাঠে নেমেছিলেন ‘জয় বাংলা’ স্টিকার নিয়ে। তাতেই দুই পাকিস্তান ছাড়িয়ে ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বে।  ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তান সফরে আসে মিকি স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে কমনওয়েলথ দল। সেই সফরে তিনটি চার দিনের ম্যাচ খেলে দুই দল। যার মধ্যে দ্বিতীয় ম্যাচটি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম)। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তান দলে রকিবুল ডাক পান। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সময় উত্তাল ছিল। এমন পরিস্থিতিতে কমনওয়েলথ দলের পাকিস্তান সফরের উদ্দেশ্য ছিল, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে আঘাত করা ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য অর্থ জোগাড় করা। 

সেই সফরে ১৯৭১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দলে যোগ দিয়ে অনুশীলনের পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল রকিবুলের। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড গ্রে নিকোলসের ব্যাটে আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ারের স্টিকার লাগানো ছিল, যা দিয়ে পরদিন ব্যাটসম্যানরা মাঠে নামে। রকিবুল সেটা মানতে পারেননি বলে হোটেলে ফিরে ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগান। ক্রিকেট মাঠে ব্যাট করতে নেমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার জন্যই স্টিকার লাগানোর মতো দুঃসাহসিক কাজটি করেন রকিবুল। যদিও দুই ইনিংসে তার ব্যাট থেকে এসেছিল মাত্র এক রান। তবে মাঠে তার উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি গুরুত্ব আর তাৎপর্যপূর্ণ। 

জয় বাংলা স্টিকার লাগানোর বিষয়ে রকিবুল বলেন, ‘দলে ডাক পাওয়ার পর হোটেল পূর্বাণীতে ৯১০ নম্বর রুমে উঠেছিলাম আমি। আমাকে অভিনন্দন জানাতে কামাল (শেখ কামাল) হোটেলে আসার পর ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার লাগানোর কথা বলি। কামালই সে সময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস থেকে স্টিকার এনে আমার অনুরোধে ব্যাটে লাগিয়ে দেয়, যা নিয়ে পরদিন আজমত রানার সঙ্গে ওপেনিংয়ে নেমেছিলাম।’ 

রকিবুল হাসানের কাছে মনে হয়েছিল, তার জায়গায় থেকে একটা নীরব প্রতিবাদ করা যায়। মূলত ১৯৬৮ সালের অলিম্পিক গেমস থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। সেই আসরে দুই অ্যাথলেট কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন করার জন্য কালো ব্যান্ড পরে হাত উঁচিয়ে ধরেছিল। ওদের নিষিদ্ধ করা হয়নি বলে রকিবুলের বিশ্বাস ছিল, এটা নজর কাড়বে। মূলত সেই ভাবনা থেকেই এমনটি করা হয়েছিল। জয় বাংলা স্টিকার লাগিয়ে ব্যাট করতে নামার পর তা মুহূর্তের মধ্যেই গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন দেশ-বিদেশের একাধিক পত্রিকায় ছাপা হয় রকিবুলের জয় বাংলা স্টিকার লাগিয়ে ব্যাট করার প্রতিবাদী ছবিটি। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এমন প্রতিবাদ করতে পেরে মনের মধ্যে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতে থাকে। যা এখনো মনের মধ্যে দোল খেয়ে যায়।

পরে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেন। জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করলেও পূরণ হয়নি টেস্ট খেলার স্বপ্ন। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস আরও অনেক পরে পাওয়ায় একটা হতাশা নিয়েই ক্যারিয়ার শেষ করেন। স্বাধীনতার আগে ও পরে মাঠ এবং মাঠের বাইরে অবদানের জন্য ২০২৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন রকিবুল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //