তাদের শেষ বিশ্বকাপ

পঞ্চপাণ্ডব। মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র পঞ্চপাণ্ডব (মহাভারতের অন্যতম চরিত্র হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র-যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবকে বলা হয় পঞ্চপাণ্ডব)।

বিশেষ্যপদ হিসেবে ব্যবহৃত ‘পঞ্চপাণ্ডব’ শব্দটি পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবমুক্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনাকারী প্রথিতযশা পাঁচজন লেখক-কবি অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও বলা হয় পঞ্চপাণ্ডব। সময়ের পরিক্রমায় মহাভারতের সেই ‘পঞ্চপাণ্ডব’ শব্দটি ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। 

শুধু ঢুকে পড়া নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে পঞ্চপাণ্ডব। আরও একটু স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ যে উচ্চতায় দাঁড়িয়ে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান এইা পঞ্চপাণ্ডবদের। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীমাত্রই জানেন দেশের ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডবের সদস্যরা হলেন- মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। একটা সময় আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ দলের লক্ষ্যই থাকত, সম্মানজনকভাবে হারা! মানে যতটা কম ব্যবধানে হারা যায়। সেই বৃত্ত থেকে দলকে জয়ী মানসিকতায় বদলে দেওয়ার মূল কারিগর হলেন এই পাঁচজন। অনন্য সেই অবদানের জন্যই তারা পেয়ে গেছেন পঞ্চপাণ্ডব খেতাব।

তবে ২০২০ সালেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই পঞ্চপাণ্ডব ভেঙে গেছে। জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন মাশরাফি, রাজনীতিতে নেমে বনে গেছেন এমপি। পঞ্চপাণ্ডবের বাকি ৪ সদস্য বাংলাদেশ দলে খেলে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, ৪ জন এখনো খেলোয়াড়ি ভূমিকায় আছেন; কিন্তু ৪ জনের মধ্যে তামিম ইকবালের জায়গা হয়নি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে। তামিম কেন দলে নেই, কেন তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কী করণে বাদ দেওয়া হয়েছে- সে এক লম্বা ইতিহাস! যে ইতিহাসের পরতে পরতে নাটকীয়তায় ভরা। গত জুলাই মাসেও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা জানত, তামিমের নেতৃত্বেই ভারতের মাটিতে ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, তামিমই ছিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক। তামিমের নেতৃত্বেই আইসিসি সুপার লিগ থেকে সরাসরি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। সেই তামিমের বিশ্বকাপে খেলাই হচ্ছে না! 

তামিম বাদে পঞ্চপাণ্ডবের বাকি তিন সদস্য সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ- তিনজনই আছেন দলে। আর বয়স বলছে, ২০২৩ বিশ্বকাপই হবে তাদের শেষ বিশ্বকাপ। তামিম দলে জায়গা পেলে তারও এটাই হতো শেষ বিশ্বকাপ। যেহেতু তিনি দলে নেই, তাই না খেলেও এই বিশ্বকাপের মধ্যদিয়েই সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে তার বিশ্বকাপ অধ্যায়ের।

এ প্রতিবেদন লেখার দিন মাহমুদউল্লাহর বয়স ৩৭ বছর ২৩৬ দিন। সাকিবের ৩৬ বছর ১৮৮ দিন, মুশফিকের ৩৬ বছর ১৪২ দিন। আরেকটি বিশ্বকাপ আসতে আসতে মাহমুদউল্লাহ ৪১ পেরিয়ে ৪২-এ হাঁটবেন। সাকিব-মুশফিক দুজনেই ৪১-তে দৌড়াবেন। ওই বয়সে শরীর ফিট রেখে ফর্ম ধরে রেখে বিশ্বকাপ মঞ্চে খেলাটা কঠিনই। প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই বয়সে কি কেউ বিশ্বকাপে খেলেনি? খেলেছে, সর্বোচ্চ ৪৭ বছর বয়সেও বিশ্বকাপ খেলেছেন একজন- নোলান ক্লার্ক। নেদারল্যান্ডসের হয়ে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে নিজের সর্বশেষ ম্যাচটা তিনি খেলেছেন ৪৭ বছর ২৫৭ দিন বয়সে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে জন ট্রাইকোস বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ খেলেছেন ৪৪ বছর ৩০৬ দিন বয়সে।

সেখানে মাহমুদউল্লাহ, সাবিক, মুশফিকরা তো ৪২, ৪১-এ পা দেবেন। তা ঠিক; কিন্তু এরই মধ্যে বয়সের ডাকটা শুনতে পাচ্ছেন মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা। মাহমুদউল্লাহ এরই মধ্যে টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানিয়েছেন। শুধু ওয়ানডে ক্রিকেটটা চালিয়ে যাচ্ছেন। মুশফিক টি-টোয়েন্টি ছেড়ে টেস্ট আর ওয়ানডে খেলছেন। সাকিব অবশ্য তিন ফরম্যাটেই খেলছেন। বর্তমানে তিন ফরম্যাটেই অধিনায়ক তিনি; কিন্তু বিশ্বকাপের পর তাদের কারও ক্যারিয়ারের দৌড় শেষও হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের বোর্ড কর্তারা এরই মধ্যে তারুণ্যের স্লোগান তুলে প্রবীণদের বিদায় বার্তা দিয়ে যাচ্ছে! মাহমুদউল্লাহ বিশ্বকাপের আগেই সেই বার্তাটা খুব ভালো করে পেয়েছেন।

টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি-তিন সংস্করণেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় রাজত্ব তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহদের। বিশ্বকাপ ইতিহাসেও তাই। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান এবং সর্বোচ্চ উইকেট- দুটি রেকর্ডই সাকিবের দখলে। বিশ্বকাপে তামিম, মুশফিকের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ২৯ ম্যাচ খেলা সাকিব করেছেন সর্বোচ্চ ১১৪৬ রান, উইকেট নিয়েছেন সর্বোচ্চ ৩৪টি, যা তাকে বানিয়েছে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডার। অন্তত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। মুশফিক ২৯ ম্যাচে করেছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৭৭ রান, তামিম ২৯ ম্যাচে ৭১৮, মাহমুদউল্লাহ ১৭ ম্যাচে করেছেন ৬১৬।

সাকিব-মুশফিক দুজনেরই এটা পঞ্চম বিশ্বকাপ। ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের মধ্যদিয়ে তাদের বিশ্বমঞ্চে যাত্রা শুরু, খেলেছেন পরের ২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে। ভারতের মাটির আসন্ন বিশ্বকাপে ১০ দলের যে ১৫০ জন ক্রিকেটার খেলতে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে তারা দুজনই বিশ্বকাপ খেলায় সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। ২০০৭ বিশ্বকাপে খেলা কোনো ক্রিকেটারই এবার বিশ্বকাপে নেই! দলে জায়গা পেলে তামিমও সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের মর্যাদা পেতেন। মাহমুদউল্লাহ খেলেছেন তিনটি বিশ্বকাপ- ২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯। তিন আসরের মধ্যে তিনি ব্যাট হাতে রাঙিয়েছেন ২০১৫ বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওই আসরে মাহমুদউল্লাহ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েন। পরে গড়েন জোড়া সেঞ্চুরির রেকর্ড। মাহমুদউল্লাহ সেঞ্চুরি দুটি আবার করেছিলেন টানা দুই ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশকে জয় এনে দেওয়ার পথে খেলেছিলেন ১০৩ রানের ইনিংস। গড়েন দেশের হয়ে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরির রেকর্ড। ওয়েলিংটনে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচেই মাহমুদউল্লাহ খেলেন অপরাজিত ১২৮ রানের ইনিংস। যেটি এখনো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড। এই রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও তার জোড়া সেঞ্চুরির রেকর্ডে ঠিকই ভাগ বসিয়েছেন সাকিব। ২০১৫ আসরে নয়, সাকিব দুটি সেঞ্চুরি করেন ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে।

শুধু মাহমুদউল্লাহর জোড়া সেঞ্চুরির রেকর্ডে ভাগ বসানো নয়, ব্যাটে-বলে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের সুবাদে ২০১৯ বিশ্বকাপে আরো অনেক রেকর্ডেই নাম লেখান সাকিব। ব্যাট হাতে ৮ ম্যাচে করেন টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬০৬ রান। ৮ ম্যাচের ৭টিতেই পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব ইনিংস খেলে ছুঁয়েছেন কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড। এক আসরে সবচেয়ে বেশি ৭টি পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব ইনিংস খেলার কীর্তি শুধু তাদের দুজনেরই। টেন্ডুলকার কীর্তিটা গড়েন ২০০৩ বিশ্বকাপে। ব্যাট হাতে বিস্ময়কর পারফরম্যান্সের পাশাপাশি সাকিব বল হাতেও নেন ১১টি উইকেট। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের বড় দাবিদারও; কিন্তু বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হওয়াতেই কি না, সাকিবের হাতে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার ওঠেনি।

অবাক করা তথ্য আছে আরও একটি। ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে তিনটি জয় পেয়েছিল- দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে, সেই তিন ম্যাচেই ম্যাচসেরা হয়েছিলেন সাকিব। এবারও তার ঘিরেই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাটা বেশি। দলের অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্বও তার কাঁধেই। দক্ষ হাতে দল পরিচালনার পাশাপাশি সাকিব কি পারবেন ব্যাটে-বলে ২০১৯-এর সেই স্মৃতি ফেরাতে?

মুশফিক সেই অর্থে কোনো বিশ্বকাপেই নিজেকে বিশেষরূপে মেলে ধরতে সক্ষম হননি। তবে নিজের সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ দিয়ে প্রতিটা আসরেই সমানতালে অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশিদের সেঞ্চুরি মোট ৫টি। তার দুটি করে মাহমুদউল্লাহ ও সাকিবের। বাকি সেঞ্চুরিটির মালিক মুশফিক। পাশাপাশি ৬টি হাফসেঞ্চুরিও রয়েছে তার। বয়স বিবেচনায় এবার যেহেতু শেষ বিশ্বকাপ, মুশফিক নিশ্চয় চাইবেন ভারতের মাটিতে বিশেষ কিছু করে দেখাতে। 

বাংলাদেশ দলে নজর কাড়া পারফরম্যান্স করার আরও অনেকেই আছেন। তবে দেশবাসীর বড় প্রত্যাশাটা তিন সিনিয়র সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহকে ঘিরেই। পঞ্চপাণ্ডবের তিন সদস্য পারবেন নিজেদের শেষ বিশ্বকাপটা নিজেদের রঙে রাঙিয়ে দেশকে ভালো কিছু উপহার দিতে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //