লালবাগের ‘জিনের মসজিদ’

প্রাচীনকাল থেকেই ঢাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য মসজিদ। আর প্রতিটি মসজিদের রয়েছে নানা ইতিহাস, গল্প। অনেক গল্প আবার হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে, কিন্তু মসজিদগুলো আজও দাঁড়িয়ে স্বমহিমায়। তেমনি একটি প্রাচীন মসজিদ খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ। পুরান ঢাকার লালবাগে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনার একটি। তবে মসজিদটির নাম খুব কম মানুষই জানেন। এমনকি এলাকারও অনেকেই জানেন না। যদিও স্থানীয়রা এটিকে দোতলা বা জিনের মসজিদ হিসেবেই চেনেন।

পুরান ঢাকার আতশখানায় অবস্থিত ৩১৮ বছরের পুরনো মসজিদটি; লালবাগ কেল্লার মেইন গেট থেকে গলি দিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়বে। এখানে এলে মসজিদটির নান্দনিক নির্মাণশৈলী দেখে যে কারও চোখ আটকে যেতে বাধ্য। লাল ইট আর চুনাপাথরের মিশ্রণে স্থাপনাটির রঙ অনেকটা পোড়া মাটির মতো। মাটি থেকে প্রায় ১৭ ফুট উঁচু স্থাপনাটি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত খান মোহাম্মদ মৃধার এ অমর কীর্তিটি আজও জমজমাট মুসল্লিদের পদচারণায়। এ এলাকার অলিগলিতে অনেক মসজিদ থাকার পরও বিভিন্ন স্থান থেকে মুসল্লিরা এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন। মসজিদের চারপাশে রয়েছে খোলা জায়গা। মুসল্লির চাপ থাকলে সেখানে চাটাই বিছিয়ে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা আছে। 

১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে নায়েবে নাযিম ফররুখশিয়ারের শাসনামলে নির্মিত হয় এই প্রাচীন মসজিদটি। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মতে, ঢাকার প্রধান কাজী ইবাদুল্লাহের আদেশে খান মহম্মদ মৃধা এটি নির্মাণ করেন। ১৭০৪-০৫ সালে তিনি এটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। মসজিদটি একটি ১৭ ফুট উঁচু বেদির ওপরে নির্মিত। ভূমি থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে মসজিদের বেদি পর্যন্ত। এই সিঁড়ি বেয়েই মসজিদে উঠতে হয়। মূল বেদি বা ছাদটি ১২৫ ফুট লম্বা, ১০০ প্রস্থ। পুরনো মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। দৈর্ঘ্য ৪৮ ফুট, প্রস্থ ২৪ ফুট। মূল মসজিদের কাঠামো তিন গম্বুজবিশিষ্ট এবং এর চারিদিকে ছোট ছোট প্রায় বিশটি মিনারের মতো কাঠামো আছে। মসজিদের উত্তরে আরেকটি ভবন রয়েছে। এতে আছে দুটি কক্ষ। এখানে সহকারী ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরা বসবাস করেন। অফিস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মূল মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার হয়। তাতে ৩০ জন করে ৯০ জন মুসল্লি জামাতে দাঁড়াতে পারেন। তবে ওপরের চত্বরে মসজিদের দুই পাশে, সামনে ও পেছনে এবং নিচে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণের চত্বরেও নামাজের জামাত হয়। সব মিলিয়ে দুই হাজারের মতো মুসল্লি জামাতে দাঁড়াতে পারেন।

মসজিদটির উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে অজুখানা। অজুখানার পাশেই আছে একটি পরিত্যক্ত কুয়া। আগে এ কুয়া থেকেই মসজিদে পানি সরবরাহ করা হতো। মসজিদ আর মাদ্রাসা ছাড়া বাকি অংশ উন্মুক্ত। ধারণা করা হয়, এখানেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হতো। আর নিচের ঘরগুলো ছিল থাকার জায়গা।

প্রচলিত লোকগল্প
মসজিদটির প্রবীণ সহকারী ইমাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান জিনের গল্প। তিনি নিজে নাকি অনেক বার গভীর রাতে মসজিদে তাদের নামাজ পড়তে দেখেছেন। প্রয়াত এক মোতাওয়াল্লি বাঘ চলাফেরা করতে দেখেছেন। এ রকম অনেকেই অনেক কিছু দেখেছেন। এমনকি খাদেম জহুরুল ইসলামকে একবার গভীর রাতে মসজিদ থেকে নাকি জিনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেই বললেন তিন বছর আগের এক রাতের সেই ঘটনা। ২৮ বছর ধরে জহুরুল এই মসজিদে খাদেমের কাজ করেন। জিনের কথা অনেকের মুখেই তিনি শুনেছেন। সেদিন কোনো এক মুসল্লির সঙ্গে জিন দেখা নিয়ে তার বাদানুবাদ হয়েছিল। জিনদের সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু হয়তো বলেছিলেন। তিনি মসজিদের চত্বরের ঘরটিতেই থাকেন। গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। তার মনে হচ্ছিল কেউ যেন খুব জোরে কিলঘুষি দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখেন, পড়ে আছেন আমলীগোলা এলাকায় এক পথের পাশে।

প্রত্নসম্পদ
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর প্রাঙ্গণে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদকে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতিরেকে এর কোনো অংশ ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করা যাবে না। যদি কারও দ্বারা কোনো ক্ষতি হয় তবে তার এক বছরের সাজা ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও কমিটির মাধ্যমে স্থানীয়রা এটি পরিচালনা করছেন বলে জানালেন মসজিদের মোতাওয়াল্লির ছেলে মইনুদ্দিন রাসেল। মসজিদটিতে বর্তমানে মোট পাঁচজন স্থায়ীভাবে কর্মরত আছেন। একজন প্রধান ইমাম, একজন সহকারী ইমাম, একজন মুয়াজ্জিন এবং দুজন খাদেম। জুমার দিনে দানবাক্সে যে টাকা ওঠে তা দিয়ে ও এর সাথে দুই মোতাওয়াল্লি ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মসজিদটি পরিচালনা হয়ে আসছে বলে জানালেন কমিটির একজন সদস্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //