অপরিকল্পিত উন্নয়নে ডুবছে ঢাকা

২১ সেপ্টেম্বর রাত ছিল রাজধানীবাসীর জন্য এক ভয়ংকর রাত। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টানা প্রায় ৬ ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় জলাবদ্ধতার নগরীতে। সেই জলাবদ্ধতায় নানা দুর্ভোগে ঘুরপাক খেতে হয়েছে ঘরমুখো মানুষকে। টানা বৃষ্টিতে সড়কের কোথাও কোথাও কোমরসমান পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।

এ সময় অধিকাংশ যান সড়কেই আটকে থাকে দীর্ঘ সময়। বৃষ্টিতে শুধু রাজধানীর রাজপথই ডোবেনি; অনেকের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটেও পানি উঠে যায়। বহু দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, ওই দিন মিরপুরে সড়কের জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে নারী-শিশুসহ চারজন করুণ মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এ তো একদিনের ঘটনা। এভাবেই বর্ষা মৌসুমে অন্তত শতবার দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয় রাজধানীবাসীকে। কারণ অল্প বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় রাজধানীর রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট। এই জলাবদ্ধতা সমাধানের জন্য হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও কোনো সমাধান মিলছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত পরিকল্পনায় বারবার জলাবদ্ধ হচ্ছে ঢাকা। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

একাধিক নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, রাজধানীর বৃষ্টির পানি যে ভূগর্ভে যাবে তেমন উন্মুক্ত স্থান নেই। ৪০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রেখে ভবন করার কথা বলা হলেও মালিকরা তা করেন না। পুরোটাই কংক্রিটে ঢেকে ফেলেন। বৃষ্টি হলে সাধারণত এই পানি খাল, বিল, নদী ও পুকুরে জমা হয়। কিছু পানি মাটির নিচে চলে যায়। রাস্তা-ঘাট, বিল্ডিং ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নেই পর্যাপ্ত পুকুর ও খাল। তাই ভারী বৃষ্টি হলে সড়কে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। এ জন্য ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোও সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। বিশেষ করে যথাযথভাবে হয়নি ড্রেনেজ, খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। আর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনে সিটি করপোরেশন এবং সরকারের অন্য সংস্থার মধ্যে ছিল না তেমন কোনো সমন্বয়ও। ফলে জলাবদ্ধতার জন্য একে অন্যকে দায়ী করেই বছর পার করছে সংস্থাগুলো।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করে ৩৮৫ কিলোমিটার গভীর ড্রেন ও ৪টি পাম্প স্টেশন এবং ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট। পানি উন্নয়ন বোর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করে ৫২টি স্লুইস গেট এবং ১টি পাম্প স্টেশন, রাজউক রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৫ কিলোমিটার লেক এবং ৩০০ কিলোমিটার জলাশয়। ডিএনসিসির ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে এবং ডিএসসিসির রয়েছে ৯৬১ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এ ছাড়া বর্তমানে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় দেওয়া হয়েছে ২৬টি খাল। তবে সব খাল ও ড্রেনেজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভরাট হয়ে যায়। তাই অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ সড়কে আবর্জনা পড়ে পানি নিষ্কাশনে ড্রেনের মুখগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এসব আবর্জনার মধ্যে পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল, বিভিন্ন খাবারের উচ্ছিষ্ট, গ্লাস ভাঙা, ময়লা কাপড় ও কাগজের ছেঁড়া অংশ ড্রেনের মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় পানি নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব ড্রেনের মুখগুলো সিটি করপোরেশনের কর্মীদের নিয়মিত পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু ছয় মাস ও এক বছরেও তাদের দেখা যায় না। এদিকে মেট্রোরেলসহ রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বিদ্যমান ড্রেনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে একটু বৃষ্টিতেই পানি সড়কে উঠছে। রাজধানীর অনেক খাল হারিয়ে প্রায় বন্ধ পানিপ্রবাহ। দখলদাররা খাল ভরাট করে গড়েছেন স্থাপনা। মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে খালের বর্জ্য অপসারণ ও দখলমুক্ত করে। তবে কদিন পরই আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

এছাড়াও ঢাকার চারদিকের নিম্নাঞ্চলগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে গেছে। এ জন্য স্লুইসগেট ও পাম্পের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে থাকা ১১টি পাম্পের চারটিই এখন বিকল। ৫৫টি স্লুইসগেটের মধ্যে কার্যকর মাত্র ১৮টি। সেগুনবাগিচা, মালিবাগ, পল্টন, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, আরামবাগসহ আশপাশের পানি সেগুনবাগিচার বক্স কালভার্ট হয়ে কমলাপুর পাম্প হাউসের মাধ্যমে মানিকনগর খালে ফেলা হয়। জিরানি ও মাণ্ডা খাল হয়ে সেই পানি বালু নদী ও বুড়িগঙ্গায় পড়ে। ওই এলাকায় তিনটির মধ্যে দুটি পাম্প বিকল থাকায় ভারী বৃষ্টিপাতে পুরো এলাকা তলিয়ে যায়।

অন্যদিকে কাপ্তানবাজার, লক্ষ্মীবাজার, আগামসি লেনসহ আশপাশের ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট হয়ে সূত্রাপুর এলাকার পাম্প হাউসের মাধ্যমে নিষ্কাশন হওয়ার কথা। সেখানকার ৩টি পাম্পের একটি দীর্ঘদিন বিকল। দুটি পাম্প দিয়ে সেকেন্ডে ১৯ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে ভারী বৃষ্টি হলে উদ্বৃত্ত পানিতে আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে।

সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া হাতিরঝিল প্রকল্প মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিতে হাতিরঝিলের সড়কগুলো ডুবে যায়। যে পাইপ ড্রেন দিয়ে পানি ঝিলে প্রবেশ করবে, সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ঝিলের আশপাশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা পানিতে থই থই করতে দেখা গেছে। হাতিরঝিলের ১ হাজার ৮৩০ মিলিমিটার ব্যাসের আরসিসি পাইপলাইনের স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা ও কার্যকারিতা বজায় রাখতে ১১টি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ৪টিতে স্থাপন করা মেকানিক্যাল স্ক্রিনিং মেশিনের দুটিই বিকল হয়ে আছে। ফলে ঝিলের চারপাশেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে একসময় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অন্যতম আধার ছিল পুকুর। পুকুরগুলো হারিয়ে যাওয়ায় পানি নামার জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর, জলাশয় ও খাল ছিল ২ হাজার। বিআইপির গবেষণা বলছে, রাজধানীতে বর্তমানে পুকুর আছে মাত্র ২৪টি। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ২০১৮ সালে ঢাকায় ১০০ পুকুর থাকলেও এখন তা ঠেকেছে ২৯টিতে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়নের কৌশল পুরোটাই গলদ। একসময় খালগুলোকে বক্স কালভার্ট করা হলো, সেগুলো ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে এখন পানি চলাচল করতে পারে না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পুকুরগুলো ভরাট করা হয়েছে। সব জায়গা কংক্রিটে ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে পানি যাবে কোথায়?

তিনি বলেন, কৃত্রিম ড্রেন কখনো প্রাকৃতিক জলাশয়ের বিকল্প হতে পারে না। রাস্তার পাশে যে ছোট ড্রেন থাকে এতে ভারী বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন সম্ভব নয়। আর এই ড্রেনগুলোও ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ থাকে। অনেক এলাকার সড়ক সমতলের চেয়ে উঁচু করে ফেলা হয়েছে। এমন অবস্থায় তো জলাবদ্ধতা হবেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা তৈরির জন্য দায়ী হচ্ছে রাস্তা পরিকল্পনা ও নির্মাণ। একটি রাস্তা তৈরির সময় সে অঞ্চলের ২৫-৫০ বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড মূল্যায়ন করে রাস্তা নির্মাণ করতে হয়। আমাদের দেশে সেটি করা হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, একটি রাস্তায় কতটুকু ড্রেন রাখতে হবে সেই হিসাবটা তারা রাখছে না। এসব প্রকল্পে বুয়েট বা অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদেরও রাখা হচ্ছে না। কোথাও নামমাত্র রাখা হলেও সেখানে তাদের কথাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। যার ফলে দেখা যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের প্রায় শহরগুলোর রাস্তার ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো না। সামান্য বৃষ্টি হলেই দুর্ভোগে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘জলাশয়, খাল, বিলগুলো দিন দিন দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে পানি সহজে নামতে পারে না। এর পরও হটস্পট চিহ্নিত করে ড্রেনের কাজ করেছি। কিন্তু পলিথিন, ময়লা-আবর্জনার কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব জলাধারই ভরাট হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই যখন ভরাট করে, তখন অন্যরা কী করবে? ফলে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী।’

রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর শামসুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘রাজউক প্রকল্প এলাকায় জলাধার রাখার চেষ্টা করে। পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পেও ১০০ কিলোমিটারের বেশি লেক রাখা হয়েছে। কাজেই রাজউক জলাধার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //