মধ্যবিত্তের ঘাড়ে বাড়তি বাড়ি ভাড়ার খড়্গ

ছোট-বড় দুই বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং, রান্নাঘর, দুটি বাথরুম- সব মিলিয়ে রাজধানী বাড্ডায় সাড়ে ছয়শ বর্গফুটের একটি বাসায় থাকেন সুমন ইসলাম। এ ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ১৮ হাজার টাকা। এর বাইরে গুনতে হয় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল। জানুয়ারিতে নতুন করে আরও দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কোনো উপায় না দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।

সুমন বললেন, ‘যে টাকা আয় করি তা দিয়ে মাস চালানোই দায়। এর মধ্যে নতুন বছরে বাড়তি বাসাভাড়া সামলানো আমার পক্ষে অসম্ভব। দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচ, লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসার চালানো, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা। তাই ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

এক তথ্য বলছে, রাজধানীর প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ থাকেন ভাড়া বাসায়। খরচের চাপে এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চিড়েচ্যাপটা, এর ওপর নতুন করে বাসাভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার নোটিশ প্রায় সবাইকেই চিন্তায় ফেলেছে। অথচ করোনাকালে অনেক বাড়িওয়ালা স্বেচ্ছায় ঘর ভাড়া কমিয়েছিলেন, অনেকে আবার মানবিক দিক চিন্তা করে ভাড়াই নেননি। তখন অবশ্য ভাড়াটিয়ারও সংকট ছিল বেশ। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় অস্বাভাবিকভাবে। 

এদিকে কোভিডের ধাক্কা শেষ না হতেই ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়তে থাকে একের পর এক পণ্যের দাম। বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের মূল্যও, যার প্রভাব পড়ে সব খাতে। এরপর একে একে বাড়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। কিন্তু বাড়েনি নগরবাসীর আয়, অনেকের ক্ষেত্রে বরং কমেছে। এর মধ্যে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির খড়্গ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এর ফলে কেবল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুমন ইসলামই নন, তার মতো আরও অনেকেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যানুযায়ী, ২৬ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। ক্যাবের জরিপে উঠে আসে, ১৯৯০ সালে ভাড়া বাড়ে ২৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ১৯৯২ সালে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ১৯৯৩ সালে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ, ১৯৯৪ সালে ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ১৯৯৫ সালে ২২ দশমিক ৬১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ১৯৯৭ সালে ১৫ দশমিক ০৩ শতাংশ, ১৯৯৮ সালে ১৪ দশমিক ০৯ শতাংশ, ১৯৯৯ সালে ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০০০ সালে ১৫ দশমিক ০৮ শতাংশ, ২০০১ সালে ১৭ দশমিক ০৪ শতাংশ, ২০০২ সালে ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ, ২০০৪ সালে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ২০১৩ সালে ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৯ দশমিক ৭৬ এবং ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। 

সর্বশেষ ক্যাবের হিসাবে, এখন ঢাকায় দুই কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিতে খরচ হয় গড়ে ২০ হাজার টাকা, যা ২০১০ সালেও ছিল ১১ হাজার ৩০০ টাকা। আর ১৯৯০ সালে মাত্র ২ হাজার ৯৪২ টাকা ছিল। এ ছাড়া পাকা ঘর কিন্তু ওপরে টিনের শেড- এমন ঘরের ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। আট শয্যাবিশিষ্ট মেস বাড়ির ভাড়াও বেড়েছে গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তির বাসাভাড়া, প্রায় ১৭ শতাংশ।

বাড়িভাড়া নির্ধারিত হয় মূলত বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার আলোচনার ওপর। ফলে ভাড়া বাড়ালেও নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। নগরবাসীর নাগরিক সুবিধাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিটি করপোরেশনেরও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। এমনকি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯১) বেশিরভাগ বিধানই ভাড়াটিয়াবান্ধব নয়। আবার ভাড়াটিয়ার অনুকূলে থাকা ধারাগুলোও বাড়ির মালিকরা মানতে চান না। আইনটির ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাড়ির অবস্থা বুঝে একটি মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। ভাড়া দেওয়ার দুই বছরের মধ্যে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া যাবে না।’ কিন্তু সেই শর্ত বাড়িওয়ালারা মানেন না। আইনের কথা বললে উল্টো বাসা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট প্রিয়লাল সাহা বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াতে পারবেন। তা-ও হতে হবে যুক্তিসঙ্গত। আর মালিক যদি ভাড়া বাড়ানোর অজুহাতে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালান তাহলে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ এবং ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে অভিযোগ জানানো যায়। সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ভাড়া নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় লিখিত চুক্তি হয়। কী কী শর্তে ভাড়া দেওয়া হলো এবং করণীয় কী, সেগুলো তাতে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ভাড়া কখন বাড়ানো যাবে এবং তা কোন হারে বাড়বে, অগ্রিম কত জমা দিতে হবে, কখন বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াকে বাড়ি ছাড়তে বলতে পারেন, ভাড়াটিয়া কখন বাড়ি ছাড়বেন, তা অবশ্যই চুক্তিপত্রে উল্লেখ করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতি মাসে ভাড়ার লিখিত রসিদ সংগ্রহে রাখা উচিত।’

ভাড়াটিয়াদের প্রতি বাড়ির মালিকদের অভিযোগও কম নয়। শাহজাদপুরের আমিনুল ইসলাম নামে এক বাড়ির মালিক বলেন, ‘বাড়িওয়ালার বাড়ি আমার কি- এমন একটা মানসিকতা থাকে বেশিরভাগ ভাড়াটিয়ার মধ্যে। অযত্নে-অবহেলায় তারা বাসার বারোটা বাজিয়ে দেন। তাছাড়া ভাড়া তুলতেও যে কী পরিমাণ ঝক্কি! ভাড়া না দিয়ে চলে যাওয়ার উদাহরণও কম না।’ 

তিনি বলেন, ‘বাড়িভাড়া বিষয়টি বাজারদর অনুযায়ীই নির্ধারিত হচ্ছে। সরকার কি বাড়ির লোন দেওয়ার সময় বাড়তি কোনো সহায়তা করে? দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি হয়, বাড়ি মেনটেইন করাও খরচ সাপেক্ষ। গত কয়েক বছরে টাকার মান কী পরিমাণ কমেছে সেটাও তো বিবেচ্য। যে কোনো দেশেই বছরে নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়। অনেক সময় বাড়ি ফাঁকা থাকে, ভাড়াও বাকি পড়ে। মানবিক কারণে ভাড়াটিয়াকে কিছু বলা যায় না। তবে কিছু বাড়িওয়ালা যে রূঢ় আচরণ করেন, তাও স্বীকার করছি।’ 

আজিমপুরের আবু তাহেরের আজিমপুরে বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন দেখি না, বাজারের ওপরই বিষয়টা ছেড়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া অন্যান্য দেশের বড় শহরের তুলনায় ঢাকার বাড়িভাড়া নিতান্তই কম।’ যুক্তি দিয়ে এই বাড়িওয়ালা বলেন, ‘কয়েক কোটি টাকা খরচ করে একটা বাড়ি নির্মাণের পর সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৫০ হাজার টাকাও থাকে না। আমার মতে একমাত্র বাড়িভাড়াটাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাড়ছে, বছরে একবার। অথচ তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ে ক্ষণে ক্ষণে, যখন ইচ্ছা তখন। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পরিবহন ভাড়া। সব মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিনের হিসাব। কয়েক বছর আগে থাকা ২৫ টাকা কেজির চাল কিনে খাচ্ছি ৭০ টাকায়। এদেশে নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়ার গতিই তো লাগামহীন।’

এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহরানে সুলতান বাহার অবশ্য বলেন, ‘প্রতিবছরই ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাসার মালিকরা। তাদের কাছে অসহায় হয়ে আছেন ভাড়াটিয়ারা। এমন সমস্যা সমাধানে আইন ও বিধি যথোপযোগী করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। মনিটরিংয়ের পাশাপাশি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে সিটি করপোরেশনকে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //