দুই মেয়রের মুখোমুখি

বাসযোগ্য মহানগরী গড়তে সহায়তা ও সমর্থন প্রত্যাশা

বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান সবার শীর্ষে। লণ্ডভণ্ড ও দূষিত এই শহরকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত দুই মেয়রকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। 

চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জনগণের আস্থা অর্জনে সামগ্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, টেকসই মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যানজট-জলজট নিরসন, পুরনো ঢাকা ও নতুন ৩৬ ওয়ার্ডকে সচল করা। 

এছাড়া পরিবেশবান্ধব উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনয়ন, নগর সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলা, ফুটপাতগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করা, বায়ুদূষণ রোধ করা ও দুই সিটির নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও পরিকল্পিত নগর গড়ার বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সাথে কথা বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নবনির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। 

দুই মেয়রই নগর ব্যবস্থাপনায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপের কথা বলেছেন। বিশেষ করে তারা নির্বাচনের আগে যে ইশতেহার দিয়েছেন, তার আলোকে প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন। 

‘ঢাকা সবার’ উল্লেখ করে বাসযোগ্য মহানগরী গড়তে দলমত নির্বিশেষে দায়িত্ব পালনে রাজধানীবাসীর ইতিবাচক পরামর্শ, সহায়তা ও সমর্থনও প্রত্যাশা করেন আতিক ও তাপস।

আতিকুল জানান, তিনি নির্বাচনের আগে দেয়া ইশতেহার অনুযায়ী সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আধুনিক ও সচল ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করবেন। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়েছেন। ঢাকার উন্নয়ন ও সবার সঙ্গে প্রায় ৫৪টি সরকারি সংস্থা সম্পৃক্ত। নগর সরকার ব্যবস্থা না থাকায় এসব সংস্থা মেয়রের নিয়ন্ত্রণে নেই। 

নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে এসব সংস্থার সঙ্গে কীভাবে কাজের সমন্বয় করবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিটি সংস্থা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। আর মেয়র জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। অতএব সরকারি সংস্থাগুলো মেয়রের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা। এজন্য প্রতি মাসে টাউন হল সভা করবো। এই সভায় সংশ্নিষ্ট সব সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকবেন। ফলে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না। এছাড়া প্রতিটি সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করব।

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ঢাকা উত্তর সিটির যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনআকাক্ষা ও জনদুর্ভোগকে বিবেচনায় রেখে তা বাস্তবায়ন করব। সিটি কর্পোরেশনের ১৪টি স্থায়ী কমিটিকে কার্যকর করবো। খেলার মাঠ, জলমহাল ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেব। শুরু থেকেই এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবো। ইতোমধ্যে নাগরিক সমস্যার অনেকগুলো বিষয় চিহ্নিত করে ফেলেছি। প্রতিটি ইস্যু ধরে কাজ শুরু করা হবে। 

মেয়র আতিক জানান, এর আগের মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে গত ৯ মাস তিনি কঠোর অনুশীলন করেছেন। এর মাধ্যমে আধুনিক ও বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, তার একটা রূপরেখা তৈরি করেছেন। এ অনুযায়ী তিনি ১৮টি ওয়ার্ডের প্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজের একটি মহাপরিকল্পনাও তৈরি করেছেন। এটি এরই মধ্যে একনেক ও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে।

আতিকুল প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে স্মরণ করে বলেন, তার নেয়া অসমাপ্ত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নেও তিনি পদক্ষেপ নেবেন। ঢাকা উত্তরে যানজট নিরসনে কয়েকটি স্থানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইউলুপ স্থাপনের কাজ শুরু করবেন। 

তিনি আরো বলেন, ‘সত্যিই ঢাকা একটি অপরিকল্পিত শহর। বিশ্বের অন্য সব শহরে আগে পরিকল্পনা তৈরি করে তারপর বসবাস শুরু হয়। কিন্তু আমরা তেমনটি পাইনি।’ 

ঢাকাকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। প্রতি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করলে সফলতা বেশি আসবে। 

কারণ একেকটি ওয়ার্ডের দাবি ও চাহিদা আলাদা উল্লেখ করে আতিক বলেন, ‘ভাটারা এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, রাস্তা উঁচু নয়, আগে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করে দিতে হবে। গুলশান এলাকার বাসিন্দারা চাইছেন, সেখানে একটি ফায়ার বিগ্রেড স্টেশন তৈরি করে দিতে। এদিকে মিরপুরের বাসিন্দারা জলাবদ্ধতা দূর করতেই বেশি তাগিদ দেন। ফলে সবার সঙ্গে পরামর্শ নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটিকে একটি মডেল সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র তাপস জানান, দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই তিনি দূষিত ও অপরিকল্পিত এই ঢাকাকে উন্নত ঢাকা হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দেবেন। এ কাজে তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করতে চান। ঢাকাবাসীকে এ কাজে তিনি পাশে চান। 

তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ সিটির খেলার মাঠ ও পার্কগুলো জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা করা হবে। সিটি কর্পোরেশনের খেলার মাঠ ও পার্কগুলো বিভিন্ন ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। সেসব মাঠে সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারছে না। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। ওই এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত, পার্ক ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা করব।’

তিনি আরো বলেন, ‘পুরান ঢাকার সড়ক খুবই সরু, সারাক্ষণ যানজট লেগে থাকে। ওই এলাকায় গড়ে ওঠেনি কোনো পার্কিং স্পেস। এসব সমস্যা সমাধান করে পুরান ঢাকাকে দর্শনীয় স্পটে পরিণত করব। এজন্য পর্যটকদের ওই এলাকায় নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করা হবে। পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা, যানজটমুক্ত সড়ক ও নতুন পার্কিং স্পেস তৈরি করব। তবে পুরান ঢাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করার ফর্মুলা রয়েছে। সংশোধিত ড্যাপে রিডেভেলপমেন্ট বা ভূমির পুনঃউন্নয়নের সুপারিশ রাখা হয়েছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে পুরান ঢাকাকেও বাসযোগ্য ও আধুনিক করা সম্ভব হবে।’ 

মেয়র তাপস বলেন, ‘এর বাইরে শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, যেটা এখনো গড়ে ওঠেনি। যানজট, জলজট নিরসন ও গণপরিবহনের শৃঙ্খলা আনয়ন, এলাকাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বিভাজন বা স্কুল জোনিং করা ও ফুটপাতগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করা।’ 

তিনি জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে ইশতেহার অনুযায়ী তিনি ‘ঐতিহ্য রক্ষা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসনের ঢাকা, উন্নত ঢাকা’- এই পাঁচ ভাগে ভাগ করবেন। 

তিনি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার পাশাপাশি এর স্বকীয় রূপকে প্রস্ফুটিত করার কথা বলেছেন। দায়িত্ব নেয়ার তিন মাসের মধ্যেই মৌলিক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। 

তাপস বলেন, ‘ঢাকাবাসীকে উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী উন্নত রাজধানী উপহার দেয়ার জন্য কাজ করব। এজন্য দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে নগর ভবনের দরজা। পুরান ঢাকার আলাদা একটি মর্যাদা, সম্মান ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করব।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পুরনো ঢাকা এলাকায় ৬০ ভাগ ও নতুন এলাকায় শতভাগ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এ বিষয়ে তাপস বলেন, ‘জনবলের ঘাটতি পূরণ করা হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’ 

এজন্য তিনি ৩০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করবেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৌলিক নাগরিক সেবাগুলো ঢাকাবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //