অটোমোবাইল শিল্প: রিকন্ডিশন্ড জাপানি গাড়িনির্ভরতা কেন কমছে না

যুগ যুগ ধরেই বিশ্বের ব্যবহৃত গাড়ির শীর্ষ রপ্তানিকারক জাপান। বিশ্বের গাড়িপ্রেমীদের কাছেও সমাদৃত জাপানের এসব সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি। ১৯৮০ এর দশক থেকে ব্যবহৃত জাপানি গাড়ি– প্রধানত টয়োটা, বাংলাদেশের অটোমোবাইল বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। রাস্তায় বেশিরভাগ গাড়িই টয়োটার, এবং ভোক্তারা এটিকে অন্য সব ব্র্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বলে মনে করেন।

প্রকৃতপক্ষে, জাপানি গাড়িগুলি এত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সেগুলোর ভাল পারফরম্যান্স এবং খুচরা যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা। স্থানীয় মেকানিকরাও টয়োটা গাড়ি মেরামত করা সহজ বলে মনে করেন। মেকানিক এবং গ্যারেজ মালিকদের একটি বড় অংশ এই গাড়িগুলি মেরামত করতে শিখেছেন, যে কারণে তাদের জীবিকাও টয়োটার ওপর নির্ভর করে।

তথ্যমতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ প্রাইভেট কার বিক্রি হয়। ২০২২ সালে নিবন্ধিত হয়েছে ২৬,৯৩৫টি প্রাইভেট কার এবং এসইউভি। তারমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই সেকেন্ড-হ্যান্ড, আর বাকি ৩০ শতাংশ সম্পূর্ণ নতুন গাড়ি। সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িগুলোর সিংহভাগই জাপান থেকে আমদানি করা।

সরকারি নীতিমালা 

র‌্যানকন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, পুরনো জাপানি গাড়ির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে আমাদের সরকারের নীতির কারণে, অন্য কিছু নয়। সরকার নীতিমালা তৈরি করেছে তাই আমরা এসব গাড়ি আমদানি করি।

তিনি বলেন, সরকার সম্ভবত ভেবেছিল যে আমরা যদি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করি তবে আমাদের কম বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে এবং মানুষও কম দামে একটি গাড়ি পাবে। 

জাপানি পুরনো গাড়ির প্রধান বাজার হল বাংলাদেশ, আফ্রিকা মহাদেশ এবং রাশিয়া। অতীতে, বাংলাদেশ আমদানিকারকদের আট বছরের কম সময় ব্যবহৃত গাড়ি আনার অনুমতি দিয়েছিল। যেগুলোর দামও কম। 

এখন সরকার আর পাঁচ বছরের বেশি পুরনো গাড়ি আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে জাপানে পুরনো গাড়ির দাম বেড়েছে এবং এ কারণে বাংলাদেশকে বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে।

মোস্তাফিজুর বলেন, আমরা আজকাল দেখছি যে জাপানের অনেক পুরনো গাড়ির দাম একেবারে নতুন গাড়ির (আমদানি করা) চেয়ে অনেক বেশি।

তিনি বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পুরানো যানবাহন নতুন গাড়ির চেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। নতুন গাড়ির তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি কার্বন নিঃসরণ করে পুরনোগুলো।

তার মতে, এখন আমাদের অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে এবং আমাদের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে, যা যানবাহনের চাহিদা বাড়াচ্ছে। কিন্তু পুরানো জাপানি গাড়ির উপর নির্ভরতা অটোমোবাইল শিল্পে বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ।

নির্ভরযোগ্য ও টেকসই

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, পুরোনো জাপানি গাড়িগুলো নির্ভরযোগ্য ও টেকসই হওয়ায় বাংলাদেশে ও সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। পুনরায় বিক্রি করার ক্ষেত্রে ভালো দাম পাওয়া যায়। 

তিনি বলেন, আমি যদি এমন একটি গাড়ির মালিক হই যার পুনঃবিক্রয় মূল্য কমে না এবং এটি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়, তাহলে আমি কেন এটি ব্যবহার করব না?

শামসুল হক বলেন, একটি গাড়ির কার্বন নিঃসরণ নির্ভর করে সেটি কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তার ওপর। আমাদের ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। যানবাহনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

এই অধ্যাপক আরো বলেন, আমাদের দেশে আমরা এখনও দূষিত জ্বালানি বিক্রি করি এবং পরিষ্কার জ্বালানি পাওয়া যায় না। আমাদের এই বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। আপনি যদি নতুন গাড়িতে এই জ্বালানি ব্যবহার করেন তবে নতুন যানটিও দূষণ তৈরি করবে।

বাংলাদেশে অটোমোবাইল শিল্প

স্থানীয় অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে সহায়তা করার জন্য অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতি-২০২১ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ, যাতে মানুষ কম দামে গাড়ি কিনতে পারে। সংশ্লিষ্ট খাতের নেতারা বলেন, স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পুরনো জাপানি গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারব।

নির্ভরতা কমাতে সরকার সেমি-নকড-ডাউন (এসকেডি) এবং কমপ্লিট নকড-ডাউন (সিকেডি) প্লান্ট স্থাপনে বিদেশি এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলিকে উৎসাহিত করছে। মূলত, এগুলি অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট।

বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএএমএ) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, চীন মিরসরাইয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। জাপানের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে গাড়ি তৈরিতে ৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে সরকার সহায়তা দেবে। তবে বড় বড় কোম্পানিগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা আমাদের দেশেই অটোমোবাইল তৈরি করতে চাই। আমাদের সরকারসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে।

নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব বলেন, অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতি-২০২১ এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে।

তিনি বলেন, আমাদের বেশিরভাগ গ্রাহক জাপানি গাড়ি কেনেন। কিন্তু এই খাতে জাপানি বিনিয়োগ কোথায়? আমরা ডব্লিউটিও অনুযায়ী পুরনো জাপানি গাড়ি আমদানি বন্ধ করতে পারি না। আমরা এটাকে নিরুৎসাহিত করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, সরকার এখন উচ্চ কর দিয়ে এবং এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন দিয়ে জাপানি গাড়ি আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে। এর প্রভাব কী? গাড়ির দাম বাড়ছে। তবে আপাতত পুরনো জাপানি গাড়ি আমদানি করা ছাড়া বিকল্প নেই।

আমদানিকারকরা যা বলছেন

কোম্পানিগুলোকে অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলিং কারখানা স্থাপন করতে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগকে পুরনো জাপানি গাড়ির আমদানিকারকরা দেখেন একচেটিয়া আধিপত্য তৈরির উপায় হিসেবে। তারা বলেন, বাংলাদেশের উচিত কমপ্লিটলি বিল্ট ইউনিটের (সিবিইউ) জন্য কারখানা স্থাপন করা।

বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, দেশে একটি অটোমোবাইল শিল্প স্থাপনে সরকারের পদক্ষেপকে তারা সবসময় স্বাগত জানান। তবে তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত সম্ভাব্য বাজার বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, মালয়েশিয়া সহ অনেক দেশ অটোমোবাইল শিল্প স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, এটি মূলত একটি ‘স্ক্রু ড্রাইভার শিল্প’ কারণ এটি একটি সংযোজন কারখানা। তারা কোরিয়া থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে আসছে এবং হয়তো বাংলাদেশে পেইন্টিং করছে।

আব্দুল হক বলেন, আমরা সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা চাই। পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধ করে দেশে নতুন গাড়ি তৈরি করলে একচেটিয়া রাজত্ব তৈরি হবে। আর বিশ্বের কোনো দেশই তা করতে পারেনি। পুরনো যানবাহন খাত এই নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //