দরিদ্রতম থেকে ধনী দেশের তালিকায় গায়ানা

ক্যারিবীয় অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি ছিল গায়ানা। এখন জ্বালানি তেল উৎপাদনকে কেন্দ্র করে দেশটি এ মহাদেশের শীর্ষ ধনী দেশে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারমাণ অর্থনীতি এটি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর মাত্র আট লাখ জনসংখ্যার এ দেশটির অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ হবে ৩৮ শতাংশ। ২০২৮ সালের মধ্যে সম্প্রসারণের মাত্রা ১০০ শতাংশ অতিক্রম করবে। আইএমএফ একা নয়, অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ মনে করে, দেশটি আগামী দিনে ব্যাপক অর্থনৈতিক উল্লম্ফন দেখবে। আগামী পাঁচ বছরে জিডিপি বাড়বে ১১৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ অর্জনের পেছনে জ্বালানি তেল উৎপাদনের ভূমিকা প্রধান হলেও রপ্তানি খাতের কথা বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।

করোনা মহামারির প্রভাবে ২০২০ সালে যখন বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল, গায়ানা তখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মোট দেশীয় পণ্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধি হয় ৪৩.৫ শতাংশ। ২০২২ সালে গায়ানার অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ৬২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৩৭.২ শতাংশে। 

গায়ানার সরকারের জন্য আর্থিক বিপর্যয়ের পথ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে স্ট্যাব্রোক ব্লক একটি বড় ক্ষেত্র হতে পারে। স্ট্যাব্রোক ব্লক হলো ৬৬ লাখ একরজুড়ে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে বিস্তৃত জ্বালানি তেলের খনি। 

এক্সন ও তার অংশীদার হেস ও সিএনওওসি এ ব্লকে তেল উৎপাদন করছে। শুধু মে মাসেই গায়ানা তেল বিক্রি করে মুনাফা পেয়েছে ৮৭ মিলিয়ন ডলার। গায়ানার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশটি পেট্রোলিয়াম থেকে ১.৪ বিলিয়ন রাজস্ব আয় করেছে। অর্থমন্ত্রী অশনি সিং জানিয়েছেন, তেল রাজস্ব, রপ্তানি ও রয়্যালটি থেকে এ বছর ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। যার পরিমাণ ১.৬৩ বিলিয়ন ডলার।

গায়ানায় চলতি বছরে দৈনিক উৎপাদিত তেলের পরিমাণ ৩ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেলে উত্তীর্ণ হবে। ২০২৭ সালের মধ্যে দৈনিক উৎপাদন দাঁড়াবে ১০ লাখ ব্যারেলের বেশি। জ্বালানি তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সন মবিলের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছে দেশটির নব আবিষ্কৃত স্ট্যাব্রোক ব্লক। এক্সন মবিলের দাবি অনুযায়ী, সেখানে এক হাজার ১০০ কোটি ব্যারেল জ্বালানি তেল মজুদ রয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভেনিজুয়েলা তাদের জন্য একটি শিক্ষা। শুধু তেল থাকলেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভেনিজুয়েলায় প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের মজুদ রয়েছে। জাতিগত দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সহিংসতায় ভুগছে দেশটি। এটি মূলত তেলনির্ভর অর্থনীতির ভঙ্গুরতা তুলে ধরে। তাই অর্থনীতিকে বহুমুখী করার চেষ্টা দেখা গেছে গায়ানায়। 

বর্ধিত জ্বালানি তেল রপ্তানি খাতের প্রভাবে দেশটিতে কর্মসংস্থানের চিত্রও বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন এসেছে সরকারি আয়ে। তবে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অর্থনীতিবিদ ভ্যালারি মারসেল বলেছেন, ‘‌সময়ের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে আসবে। এজন্য আগামী দিনগুলোয় গায়ানার উচিত তার অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক বানানো।’ গায়ানার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা হয়ে উঠছে জ্বালানি তেলের মজুদ। ২০২২ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬২.৩ শতাংশ। বিশ্বে আর কোনো দেশের জিডিপির হার এত বেশি নয়। জ্বালানি তেল বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশটিতে নতুন তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানের কার্যক্রম জারি আছে। সমান অনুপাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে তেলবহির্ভূত অন্যান্য খাত। পরিবহন ও আবাসন খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে বিনিয়োগ। দেশটির কৃষি, খনি ও বাণিজ্যিক খাতও প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করছে। বিএমআই রিসার্চের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু ট্রাহানের মতে, অন্তত আগামী দুই বছর দ্রুত প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে গায়ানা শীর্ষস্থান দখলে রাখবে।

১৯৫৯ সালে প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর নেদারল্যান্ডসের শিল্পোৎপাদন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তার কারণ নেদারল্যান্ডস মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে পর্যটন ও শিল্পোৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। অর্থনীতিতে বহুমাত্রিকতা বাড়াচ্ছে। 

গায়ানার জন্য ঝুঁকি যে নেই, তা নয়। বিশেষ করে দুর্নীতি ও মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে টেকসই করার জন্য গায়ানাকে বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন ট্রাহান। তিনি বলেন, ‘‌আদি ভারতীয়, আফ্রিকান ও গায়ানিজ জনগণের মাধ্যমে বহুধা বিভাজিত গায়ানার ইতিহাস ও সংস্কৃতি। রয়েছে সংঘাত, দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতার ইতিহাস। জ্বালানি তেলের অর্থ সে বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।’

দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চল এবং সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ গায়ানায় দারিদ্র্য ও বেকারত্বের হার খুবই উচ্চ। সে হিসাবে দেশটির জন্য তেল আবিষ্কারের খবর নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু ইতিহাস গায়ানাকে একটি সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে দেখা গেছে, বড় ধরনের তেলের উৎস আবিষ্কার হওয়ার পর দুর্নীতির মাত্রা প্রচণ্ড হারে বেড়ে গেছে। আর এতে সেই তেলসম্পদ অপচয় বা চুরি হয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশের এ ধরনের ঘটনাগুলো ‘তেল অভিশাপ’ হিসেবে পরিচিত।

বৈশ্বিক দুর্নীতিবিরোধী এনজিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের স্থানীয় প্রধান ট্রয় থমাস বলেন, গায়ানায় দুর্নীতি ক্রমে বাড়ছে। তেল অভিশাপের বিষয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। একে তেল অভিশাপের প্রাথমিক ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। গায়ানার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির প্রধান ভিনসেন্ট অ্যাডামস বলেন, ‘অন্যান্য দেশেও আমাদের এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। তেলসম্পদ পাওয়ার পর তাদের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। এ ফাঁদ থেকে বাঁচার উপায় আছে। শিক্ষাই একমাত্র উপায়। গায়ানা এবং যে কোনো দেশের জন্য এটিই বিনিয়োগের সর্বোত্তম খাত।’ 

গায়ানার উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান গায়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগ পুনর্গঠনের বিষয়ে জোর দিয়েছেন তিনি। বিভাগটির ডিন এলিনা ট্রিম বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এখন পর্যন্ত পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মসূচির কোনো ল্যাব নেই।’ পেট্রোলিয়াম প্রকৌশলী তৈরি করতে না পারলেও এখানকার অন্য প্রকৌশলীদের তেল খাতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দুই বছর আগে ১০ জনকে এ খাতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত বছরও একই নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের আরও ২০ জন কর্মী প্রয়োজন।

জর্জটাউনের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর একটি সোফিয়া। এ অঞ্চলের মানুষকে তেমন একটা আশান্বিত হতে দেখা যাচ্ছে না। এখানকার অল্প কিছু বাড়ি ও কুঁড়েঘরে বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। একটি ইউথ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা কলিন মার্কস আশঙ্কা করছেন, সম্ভাব্য নতুন সম্পদ এ অঞ্চলের মানুষের উপকারে আসবে না। এ ছাড়া দেশের জন্য এ সম্পদ কতটা উপকারে আসবে, এ বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি নাইজেরিয়া, গিনি ও ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদের পরিণতির বিষয় উল্লেখ করেন। এসব দেশ তেল সম্পদ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিয়েছে। স্থানীয়রা তা থেকে প্রাপ্য সুবিধা লাভ করতে পারেনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //