গমের চাহিদা মেটাতে কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গম। বার্ষিক ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১১ লাখ টন। বাকি প্রায় ৮৫ ভাগই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। এর সবচেয়ে বড় উৎস পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন।

তবে প্রতিবেশী রাশিয়া দেশটির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে বৈশ্বিকভাবে গমসহ খাদ্যশস্য সরবরাহে সংকট দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ বা বিএসজিআই’ চুক্তি হলে কৃষ্ণসাগর দিয়ে আবারও শস্য রপ্তানি শুরু করে ইউক্রেন। এ চুক্তির আওতায় দেশটি থেকে স্পেন ও তুরস্কের পর সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। তবে সম্প্রতি কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি থেকে রাশিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় শুরু হয়েছে নতুন সংকট। 

ইউক্রেন, রাশিয়া ও ভারত- প্রধান এ তিন উৎস থেকেই সবচেয়ে বেশি গম আসে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ইউক্রেনের বিকল্প উৎস ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে গত বছরের মার্চ থেকে গম রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। ফলে সরবরাহ সংকটের কারণে দেশের বাজারে সর্বোচ্চে ওঠে আটার দাম। ইউক্রেন থেকে গম আমদানি শুরু হলে বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফেরে। তবে ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে বিনা বাধায় শস্য রপ্তানির বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। রাশিয়ার আপত্তিতে নতুন করে আর তা নবায়ন হয়নি। এতে বাংলাদেশের গমের বাজারে বড় সংকট তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভারত ও ইউক্রেন- প্রধান এ দুই উৎস থেকে গম আমদানি বন্ধ থাকায় আটার দাম আরও বেড়ে যাবে। দেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভাতের পরই গম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। এ কারণে গমের সরবরাহে ব্যাঘাত হলে বা দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই বিকল্প উৎসগুলো থেকে গম আমদানি শুরু করতে হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সব ব্যাংক রাশিয়া থেকে গম আমদানির ঋণপত্র খুলতে চায় না। এ বিষয়েও সহনশীল হতে হবে ব্যাংকগুলোকে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, ‘নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আরেকটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে শস্য চুক্তি নবায়ন না হওয়ার প্রভাব আমাদের দেশে বেশি পড়বে। বিশেষ করে গম ও সারের ক্ষেত্রে। গত মার্চে যখন মেয়াদ বাড়ানো হয়, তখনই চুক্তি থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তাই আগেই বিকল্প উৎস থেকে বেশি গম আমদানি করা প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে সরকারের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন গমের দাম বাড়ছে। সে হিসেবে সরকারকেও এখন বেশি দামে প্রয়োজনীয় এ পণ্যটি কিনতে হবে। সার্বিকভাবে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে।’ 

শস্যচুক্তি নবায়ন না হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব সার্বিকভাবে দেশের কৃষি খাতের ওপর পড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন থেকে সার আমদানি করা হয়। এখন সার আমদানি কম হলে এর প্রভাব সার্বিকভাবে কৃষি খাতের ওপর পড়বে।’

আইএফপিআরআই থেকে প্রকাশিত ‘রাশিয়া টার্মিনেটস দ্য ব্ল্যাক সি গেইন ইনিশিয়েটিভ : হোয়াটস নেক্সট ফর ইউক্রেন অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শস্যচুক্তির আওতায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ টন কৃষিপণ্য রপ্তাানি করে ইউক্রেন। এর মধ্যে গম রপ্তানি হয় ৮৯ লাখ ১১ হাজার ২৩০ টন। ইউক্রেন থেকে সেই গম আমদানি করেছে ৩০টি দেশ। তৃতীয় আমদানিকারক বাংলাদেশ কিনেছে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ২৪২ টন গম। 

কমোডিটি মার্কেট থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে গমের দাম ছিল টনপ্রতি ২৩১ ডলার (ইউএস-এইচআরডব্লিও) ও ২২৭ ডলার (এসআরডব্লিও)। ২০২১ সালের গমের বৈশ্বিক দাম ছিল যথাক্রমে ৩১৫ ও ২৮১ ডলার। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বছরজুড়ে গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩০ ও ৩৮২ ডলারে। শস্যচুক্তির পর গমের বৈশি^ক দাম ২৫৭ ডলারে নেমে আসে। যদিও দেশের বাজারে নিত্যপণ্যটির দাম আশানুরূপ কমায়নি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। গমের ধারাবাহিক দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে পাইকারি ও খুচরায় দাম কমানোর পর্যায়ে আসার মুহূর্তেই রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটল। এতে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের জন্য নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কানাডা থেকে আমদানি হওয়া গম লেনদেন হচ্ছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ২ হাজার টাকা, এসও (সরবরাহ আদেশ) পর্যায়ে ১ হাজার ৮৫০ টাকায়। এছাড়া রাশিয়া ও ভারত থেকে আমদানি হওয়া গম লেনদেন হচ্ছে এসও পর্যায়ে ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৪৬০ টাকায়। যদিও একই মানের গম গুদাম থেকে সরাসরি সংগ্রহ পর্যায়ে বা রেডি গম ১ হাজার ৬০০ টাকায়। তবে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তিতে ফিরে না এলে দেশের বাজারে গমের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। 

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে গমের দাম কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছিল। কিন্তু আমদানিপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় দেশের বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। আমদানিপ্রক্রিয়া শেষে বর্তমানে দাম কমে আসার কথা থাকলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে উল্টো বাড়ার আশঙ্কাই বেশি। এতে পূর্বের কম দামে কেনা গমও বাড়তি দামেই কিনতে হবে ভোক্তাদের। গম আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘শস্যচুক্তি না থাকায় গমের জন্য বড় সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে যে গম আসত সে সম্ভাবনা কমে গেছে। এখন বিকল্প উৎস থেকে গমের সংগ্রহ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া শস্যচুক্তি বাতিল হওয়ায় বিশ্বব্যাপী গমের দামও বেড়ে যাবে।’ 

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের বাজারে খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫২ টাকায়, প্যাকেট আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। যদিও ২০২২ সালের একই সময়ে দেশে খোলা আটার দাম ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা ও প্যাকেট আটা ৪৮ থেকে ৫৪ টাকা। অপরদিকে বর্তমানে কেজিপ্রতি খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ও প্যাকেট ময়দা ৬২ থেকে ৭০ টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে দেশে খোলা ময়দার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং প্যাকেট ময়দার দাম ছিল ৬২ থেকে ৭০ টাকা। বর্তমান বৈশ্বিক দাম বিবেচনায় সর্বশেষ সপ্তাহে দেশে আটা ও ময়দার দাম কোম্পানিগুলো কমিয়ে আনলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দাম ফের বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। 

দেশের খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে আটা ও ময়দার দাম কিছুটা কমে এসেছে। বিশ্ববাজারে দাম অনেক কমে এলেও শস্যচুক্তি নবায়ন ভেস্তে যাওয়ায় ধারাবাহিকভাবে দাম বাড়তে পারে। তবে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারিভাবে ঋণপত্র খোলা গমের সরবরাহ হতে আরও অন্তত এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। ফলে কেনা গমের সরবরাহ শেষ হওয়ার আগে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। ফলে পূর্বের কেনা গম বাড়তি দামে বিক্রি যাতে করতে না পারে সে বিষয়ে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন তারা। 

খাতুনগঞ্জের এসও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রাজ্জাক বলেন, ‘বর্তমানে যে দামে গম বিক্রি হচ্ছে সেটি অনেক বেশি। বিশ্ববাজার থেকে গত কয়েক মাসে যে গম কেনা হয়েছে সেগুলো দেশে আসলে গমের দাম মণপ্রতি অন্তত ১০০ থেকে দেড়শ টাকা কমে যাওয়ার কথা। ব্যবসায়ীরা বর্তমান বিশ্ববাজারের সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের বাজার মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান দেশের বাজার ব্যবস্থার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, ‘দেশের বাজার ব্যবস্থা এতই দুর্বল যে সুযোগ পেলে ব্যবসায়ীরা বাড়তি লাভ করতে চায়। এ কারণে অস্থিতিশীলতার একটা শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আমরা এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছি যে সবাই চাচ্ছি কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়। কিন্তু এখন উল্টো মূল্যস্ফীতি বাড়ার একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে।’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //