কম দামের পোশাকেই গার্মেন্টস শিল্পের ভরসা

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পশ্চিমের বাজারে ভোক্তা চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে।

এর ফলে সৃষ্ট অস্থির অর্থনৈতিক প্রভাব ইতোমধ্যে রপ্তানিকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। আর্থিক সংকটে পড়ে দেশের অনেক কারখানাই শ্রমিকদের ঠিক সময়ে মজুরি দিতে পারছে না। 

স্পেনভিত্তিক বৃহৎ একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে বছরে অন্তত ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের পোশাকপণ্য কেনে। এর মধ্যে যেসব মৌলিক পোশাকপণ্য নেয় পশ্চিমা বাজারগুলোয় যার খুচরামূল্য ২ ডলার থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ২০ ডলার। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বল্পমূল্যের এসব পোশাকেরও বিক্রি কমেছে।

তবে এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের ধসের ইঙ্গিত নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও শঙ্কার বিষয় হলো, যুদ্ধসৃষ্ট মন্দার কারণে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি দাম কমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থাৎ আরও কমে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিতে চায় তারা।  

প্রতিষ্ঠান ও নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্পেনের ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলেন, বিগত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাগুলোতেও মৌলিক পণ্য তৈরিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। সদ্য শুরু হওয়া যুদ্ধসৃষ্ট মন্দাতেও পুরনো সেই সক্ষমতা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তা চাহিদায় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ফাস্ট ফ্যাশনের উচ্চমূল্যের পোশাক তেমন আর কিনছেন না ভোক্তারা।

আবার যার কিনছেনও, তাদের আগ্রহ তুলনামূলক কম দামের বিলাসী পণ্যে। সব মিলিয়ে এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে পশ্চিমা বাজারগুলো থেকে বাংলাদেশে আসা পোশাকের ক্রয়াদেশ।

এদিকে ভোক্তার রুচি বিবেচনায় নিয়ে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় যে এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) মূল্য প্রস্তাব করতেন, তা কমিয়ে দরকষাকষির প্রস্তুতি শুরু করেছেন। 

পশ্চিমা বাজারগুলোর ভোক্তা চাহিদা নিয়ে একই ধরনের মত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেক বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটি বছরে ন্যূনতম ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক কেনে। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ প্রতিনিধির কাছে জানতে চাওয়া হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট মন্দায় ভোক্তারা এখন কোন ধরনের পণ্যের প্রতি আগ্রহী? 

এ বিষয়ে তিনি বলেন, খাদ্য ও জ্বালানিতে তাদের (ভোক্তা) বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে বিধায় সামগ্রিকভাবে ভোগ ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ভোক্তাই শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক কিনতে আপস করছেন না। এছাড়া বারবার কিংবা বেশি দিন ব্যবহার করা যায়, এমন পোশাক কিনছেন। 

এছাড়া কম বা বেশি দামের ফাস্ট ফ্যাশনের স্বল্পমেয়াদি পণ্যের চাহিদা কমেছে ব্যাপকভাবে। 

পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদা ও ভোক্তা আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট জেম আলতান বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিমা বাজারগুলোয় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তাই বেশি দামের ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক পণ্য থেকে দূরে থাকছেন ভোক্তারা। এ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বায়াররাও ফাস্ট ফ্যাশন থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

উৎপাদন উপকরণ ও প্রক্রিয়া বিবেচনায় মোটা দাগে বাংলাদেশ দুই ধরনের পোশাক তৈরির সক্ষমতা রাখে। ওভেন ও নিট। এ দুই ক্যাটাগরিতে মোট ১২ ধরনের পোশাকপণ্য তৈরি করেন বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকরা। এসব পণ্যের মধ্যে আছে ট্রাউজার, নিটেড শার্ট, সোয়েটার, আন্ডারগার্মেন্টস, অ্যানোরাক্স অ্যান্ড উইন্ড-শিটার্স, মেনস বা বয়েজ ওভেন শার্ট, বেবিজ গার্মেন্টস, লেডিস শার্টস অ্যান্ড ব্লাউজেস, কোটস ও ওভারকোটস, স্যুটস ও ট্র্যাকস্যুটস, জ্যাকেটস ও ব্লেজারস প্রভৃতি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান থেকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমএই সংকলিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসেই ওভেন ও নিট পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির গতি কমছে। জুলাই মাসে ওভেন পোশাকের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৩ দশমিক ১১ শতাংশ ও নিট পোশাকের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। আগস্টে ওভেন পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় ৪৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ আর ২৮ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল নিট পোশাকের।

সেপ্টেম্বরে এ দুই ধরনের পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে বা ঋণাত্মক, যার হার ওভেনের ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ৬৬ ও নিটের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ। অক্টোবরে ওভেন পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৭১ ও নিট পোশাকে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক কারখানাগুলোর সংগঠন প্রতিনিধিরা বলছেন, নিট ও ওভেন দুই ধরনের পণ্যেরই বর্তমান চাহিদা শ্লথ। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এমন ওভেন ও নিট পোশাকপণ্য কিনছেন ক্রেতারা। যদিও পরিমাণে সেটা একেবারেই কম। আবার যে পোশাক এক-দুইবার ব্যবহারযোগ্য সেগুলোর দিকে ক্রেতাদের ঝোঁক নেই বললেই চলে।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, একদিকে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া। ফলে বায়ারের নির্ধারিত সময়ে অর্ডার শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি আগের ক্রয়াদেশ নিতে এবং রপ্তানি বিল পরিশোধেও টালবাহানা করছে বায়াররা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতা। সব মিলে পোশাক খাতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বিগত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাগুলোতে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ধারণার প্রচলন দেখা যেত। সেটি হলো, মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতে পড়বে না। 

কারণ ওই সময় ভোক্তারা কম দামি পোশাক ঠিকই কিনবেন, যেগুলোতে বাংলাদেশের সক্ষমতা বেশি বা অনেক ভালো। কিন্তু এবারের মন্দার পরিস্থিতিটি ভিন্ন। অন্যান্য মৌলিক চাহিদার ভোগ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের ওপর চাপ পড়ছে। পশ্চিমা একজন ভোক্তার জ্বালানি ব্যয় ১০ ডলার থেকে তিনগুণ বেড়ে হয়েছে ৩০ ডলার।

এ কারণে ভোক্তা যে শ্রেণিরই হোন না কেন পোশাক কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। তারা এখন আর পুরনো পোশাক ফেলে দিয়ে নতুন কাপড় কিনছেন না।

বরং তাদের মধ্যে পুরনো পোশাক ধুয়ে বারবার পরার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নিট ও ওভেন সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই ভোক্তার এমন আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে যে কারখানা দামি পোশাক রপ্তানি করে তারও ক্রয়াদেশ কমছে আবার যে কারখানা কম দামের টি-শার্ট বানায় সেটিরও ক্রয়াদেশ কমছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //