ডলার সংকট

ওষুধশিল্পে অশনিসংকেত

দেশে প্রায় তিনশর মতো ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের, যারা দেশের বাজারের প্রায় ৯০ ভাগ ওষুধই তৈরি করে। পাশাপাশি বিশ্বের শতাধিক দেশে এসব কোম্পানি তাদের ওষুধ রপ্তানি করছে। রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাকের পর ওষুধ খাতকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে।

তবে এ শিল্পের কাঁচামালের ৭০ শতাংশই আনতে হয় বিদেশ থেকে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট।

তাই ঋণপত্র বা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খুলতে পারছেন না আমদানিকারকরা। এতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনা সম্ভব হচ্ছে না। উৎপাদন অব্যাহত রাখতে না পারায় ছোট অনেক ওষুধ কোম্পানিই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও যে পরিমাণ কাঁচামালের মজুদ রয়েছে তাতে খুব বেশি হলে দুই-তিন মাস চলতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সব মিলিয়ে ব্যাহত হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ। আবার নানা জটিলতার কারণে অনেক জরুরি ওষুধও আমদানি করা যাচ্ছে না। এর সুযোগ নিচ্ছে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। নিত্যপণ্যের মতোই হু হু করে বাড়ছে জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। সরকার ওষুধের দাম বেঁধে দিলেও খুচরা বিক্রেতাদের অনেকেই তা মানছেন না।

দেশে এখনো মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের বড় অংশই ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। সেখানে ওষুধ ভেদে বড় ব্যবধানে দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞদের দাবি- এভাবে ওষুধের দাম বাড়লে চিকিৎসা বড় সংকটে পড়বে।

বাংলাদেশে ওষুধশিল্প সমিতি জানিয়েছে, স্বাধীনতার আগে দেশে দেশি ওষুধ কোম্পানি ছিল দুটি। আর দেশে এখন নিবন্ধিত কোম্পানি আছে ২৭৪টি। এর মধ্যে বর্তমানে চালু ২১৪টি কোম্পানি। এসব কোম্পানি সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজনের ৯৭ শতাংশ দেশেই তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারসহ শতাধিক দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

ওষুধের পরিমাণগত ও গুণগত মানের এ উন্নতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়েছে। তবে সবকিছুই ম্লান হতে বসেছে কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা নিয়ে সমস্যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় গেল অক্টোবরে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। অক্টোবরে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় উভয়ই ৭ শতাংশের বেশি হারে কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুই উৎসেই পতন হওয়ায় ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি হয়েছে স্ফীত। আর এ ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এতে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। আর এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় হার ৮৫ থেকে বেড়ে ১০৫ টাকায় ঠেকেছে। 

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, সহসা দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।

ওষুধশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ উৎপাদনের জন্য দরকার প্রযুক্তি তথা যন্ত্রপাতি, বিনিয়োগ ও জনবল। দেশে এর কোনোটির ঘাটতি নেই। ওষুধ শিল্প বিকাশে এটাই বড় শক্তি। তবে এ শিল্পের একটি প্রধান সমস্যা কাঁচামাল। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়।

এর মধ্যে ৪০ শতাংশ আসে চীন থেকে, ৩০ শতাংশ ভারত, ১০ শতাংশ আসে কোরিয়া আর বাকিটা জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। ওষুধশিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মুক্তাদির বলেন, কয়েক মাস আগেও ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৮৫ টাকা ডলারে; কিন্তু শিপমেন্ট পৌঁছানোর পর ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি ডলারে বাড়তি গুনতে হয়েছে ৩০ টাকা করে।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব আলী বলেন, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সরবরাহে যাতে সংকট দেখা না দেয় সরকার সেদিকে নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছে। তা ছাড়া কাঁচামাল সমস্যাটি স্থায়ীভাবেই দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে একটি এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট) পার্ক। সেখানে ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করা হবে।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনেকে কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এখানে কাঁচামাল উৎপাদন শুরু হলে দেশের ওষুধশিল্প আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত জুলাই মাসে বহুল ব্যবহৃত ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। এর মধ্যে প্যারাসিটামল ও ব্যাথানাশকের পাশাপাশি রক্তচাপ, হৃদরোগ, পেটে গ্যাসের সমস্যায় নিয়মিত ব্যবহৃত ওষুধগুলোর দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ কিছু ওষুধের দাম ছাড়িয়েছে দ্বিগুণ।

আর আমদানি করা ওষুধের দামের ওপর কারও হাত নেই, যে যার মতো বিক্রি করছে। কোম্পানিগুলো আরও বেশকিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রেও বিশ্ববাজার, ডলার, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই নিয়মিত নজরদারি। এ সুযোগে ফার্মেসি মালিকরা বেশি দাম নিচ্ছেন। উচ্চমূল্যের পাশাপাশি আছে ভেজাল ওষুধ। 

দেশে যেসব ওষুধ তৈরি হয় না সেগুলো আমদানি করতেও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে দেশে উৎপাদন করতে না পারায় বর্তমানে ক্যান্সার, কিডনি, নিউমোনিয়া, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আমদানি জরুরি হয়ে পড়েছে; কিন্তু এক্ষেত্রে এলসি করতে আছে নানা জটিলতা।

এ কারণে সময়মতো রোগীদের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কাঁচামাল আমদানির জন্য সময়মতো এলসি করতে না পারায় ওষুধের উৎপাদন কমছে। ওষুধের দোকানগুলোতে গিয়েও জীবনরক্ষাকারী অনেক ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রেতারা জানান, সংকট থাকায় ৩০ শতাংশ ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দেবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যমতে বাংলাদেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ শতাংশই ওষুধ বাবদ খরচ হয়।

এখন এই বাড়তি দাম রোগীর ওপরে চাপ আরও বাড়াবে, যার সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার অতিপ্রয়োজনীয় কেবল ১১৭টি ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর বাইরে যে ওষুধ রয়েছে, সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকরা।

ফলে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সংকটের মধ্যে অসাধু সুযোগসন্ধানীরা বাড়তি মুনাফার লোভে তৎপর হয়ে উঠছে। আবদুল মুক্তাদির অবশ্য বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় মূল্যবৃদ্ধি, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও সরবরাহব্যয়, জ্বালানি তেলের দাম, বিপণনব্যয় বাড়ার প্রভাব পড়েছে ওষুধের বাজারেও। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //