তুলার দেশে খরা, উৎপাদন কমায় দুশ্চিন্তায় পোশাক খাত

বিশ্বের তুলা উৎপাদনকারী দেশ চীন, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ব্রাজিল ও আফ্রিকায় চলছে ব্যাপক খরা। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কানাডা ও আফ্রিকার মতো বিশ্বের প্রায় সব বড় তুলা সরবরাহকারী দেশ চাহিদা মতো তুলা দিতে পারবে না।

ব্লুমবার্গের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলা উৎপাদন ২৮% ও ব্রাজিলে ২৭% হ্রাস পাবে। ভারতেও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে উৎপাদন।

চীনে খরার কারণে শক্তিশালী ইয়াংজি নদী শুকিয়ে গেছে শঙ্কাজনকভাবে। যা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে। নদীটি দিয়ে জাহাজ চলচাল বন্ধের উপক্রম। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) অতিরিক্ত পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ইনচার্জ) মনসুর আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে খরার কারণে তুলা উৎপাদন কমে গেলে বাংলাদেশে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০%-১১%, ব্রাজিল থেকে ৪%-৫% তুলা আমদানি করি। চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি তুলা আমদানি করে, কিন্তু আমরা চীন থেকে সুতা ও কাপড় আমদানি করি। সুতরাং, নেতিবাচক প্রভাব এড়ানোর সুযোগ নেই।

মিথিলা টেক্সটাইল লিমিটেডের পরিচালক হিমেল খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশে তুলা উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

“তুলার দাম অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে এটি আমাদের উৎপাদন খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু ক্রেতারা এখনও পোশাক প্রস্তুতকারকদের ন্যায্য মূল্য দিতে নারাজ, যা টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”

৩৩% তুলা রপ্তানি করে শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এরপর ব্রাজিল ১৭% এবং ভারত ৯%।

বিশ্বব্যাপী অর্ডার বাতিল করেছে ওয়ালমার্ট

দেশের পোশাক খাতের চতুর্থ বৃহত্তম আমদানিকারক ওয়ালমার্ট অর্ডার বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে লোকসানের আশঙ্কা করছে দেশের পোশাক প্রস্তুতকারীরা।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ওয়ালমার্ট তাদের ক্রয় আদেশ ৩০% বাতিল করেছে।

তিনি বলেন, তারা কিছু অর্ডারের চালানের সময়ও পিছিয়ে দিচ্ছে।

বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ইউরো-আমেরিকা অঞ্চলের অনেক দেশকে প্রভাবিত করেছে। 

তিনি বলেন, পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব পড়ার শঙ্কা ছিল আগে থেকেই। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ চেইন শপ ওয়ালমার্টের ঘোষণার মাধ্যমে সেই ভয়টি এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

বিভিন্ন কারণে এরই মধ্যে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এটি শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা।

তিনি বলেন, ওয়ালমার্ট আমাদের বড় গ্রাহক। তাদের অর্ডার বাতিল করার অর্থ হলো বিলিয়ন ডলার মূল্যের অর্ডার বাতিল হওয়া। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের জন্য কাজ করে এমন কারখানাগুলো চালানো কঠিন হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে এবং উন্নয়নের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই।

বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান কার্যালয় ইউরোস্ট্যাটের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের জুলাই মাসে ইউরোজোনে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮.৯%, যেখানে ইইউভুক্ত দেশে ৯.৮% ও যুক্তরাজ্যে ১০.১%, বৃদ্ধির হার কমেছিল।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬০%-এর বেশি পোশাক রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য।

স্ট্যাটিস্টা ডেটা অনুসারে, ২০২২ সালের জুলাইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতিও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সেটি দাঁড়ায় ৮.৫%।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে, এসব বাজার থেকে ক্রয় আদেশ ৩০-৩৫% কমেছে।

শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ক্রয়াদেশ কমছে। অনেক বড় কারখানা রয়েছে যারা প্রতিদিন চালু হওয়ার পর তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

বিজিএমইএ কর্মকর্তারা আরও বলেন, কম অর্ডার, ডেলিভারিতে দেরি ও জোরপূর্বক ছাড়ের কারণে আগস্টে দেশের রপ্তানি আয় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জ্বালানির দাম বৃদ্ধি

স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ ১২%-১৫% বেড়েছে এবং উৎপাদন খাতের জন্য আনুষাঙ্গিক খরচ ২০%-৪০% বেড়েছে। 

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সুতার দাম ৬২%, পণ্য পরিবহন খরচ ৫০০% এবং রাসায়নিক খরচ ৬০% বৃদ্ধিও খাতকে প্রভাবিত করেছে।

শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, তুলা উৎপাদনকারী দেশে খরা, ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল ও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির কিছু কারণও এখন শিল্পকে প্রভাবিত করছে।

তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, লোডশেডিং ও গত কয়েক মাস ধরে গ্যাসের ঘাটতির কারণে উৎপাদন এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণেও অনেক সংকট তৈরি হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //