অর্থনৈতিক সংকট ছড়িয়ে পড়তে পারে এশিয়ার অন্য দেশেও

অর্থনৈতিক সংকট শুধু শ্রীলঙ্কাতেই সীমাবদ্ধ নেই। ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ একই সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে গত শনিবার (১৬ জুলাই) আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এমন সম্ভাবনার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন।

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, যেসব দেশের ঋণের পরিমাণ বেশি ও সীমিত নীতি রয়েছে তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হতে পারে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকট এসব দেশের জন্য সতর্কবার্তা।

তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো পরপর চার মাস ধরে টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে, যা তাদের উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্বপ্নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধ আমদানি করতে পারছে না শ্রীলঙ্কা। এতে চরম বিপাকে পড়েছে দেশটির দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। তাছাড়া এক বছর আগের তুলনায় খাদ্যের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। চলতি বছরে শ্রীলঙ্কার রুপির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে।

এদিকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। এটি সোমবার (১৮ জুলাই) থেকে কার্যকর হয়েছে।

বিক্রমাসিংহে একটি নোটিশ জারি করে বলেন, জননিরাপত্তা, শৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রয়োজনীয় সরবরাহ ও পরিষেবার রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে জনসাধারণের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা প্রয়োজন।

বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ঋণের কারণে গত ২০ বছরে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে ঋণ খেলাপি হয়েছে শ্রীলঙ্কা।

কর্মকর্তারা আইএমএফের সঙ্গে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেলআউটের জন্য আলোচনা করলেও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে আপাতত সেটি থমকে আছে।

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চ মাত্রার ঋণ ও বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ছাড়াও বহুকিছু এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। 

উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম বড় প্রভাবশালী ঋণদাতা চীন। ফলে তারা চাইলে উপায় বের করে দেশগুলোর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বেইজিংয়ের ঋণ দেওয়ার শর্ত ও ঋণ পুনর্গঠনের বিষয় অস্পষ্ট থাকায় সেটিও দুরূহ হয়ে পড়েছে।

এ কারণে অন্য দেশগুলোও একই সংকটের পথে হাঁটছে।

বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি 

গত ৮ বছরের মধ্যে মে মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চে ৭.৪২% ছুঁয়েছে।

রিজার্ভ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার অ-প্রয়োজনীয় আমদানি রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। রেমিট্যান্স আকৃষ্ট করতে বিদেশে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ অভিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কমিয়েছে।

এসএন্ডপি গ্লোবাল রেটিংয়ের বিশ্লেষক কিম ইং টান বলেন, বর্তমানে ঘাটতি এড়াতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশের কাছে সরকারের কাছে ভর্তুকিগুলো বড় বাধা হয়ে দারিয়েছে। ফলে তারা অনেকেই আইএমএফ ও অন্যান্যদের কাছে সহায়তার জন্যে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে। একই কারণে ভোক্তাদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়েছে।

এদিকে খাদ্যের দামও বেড়ে চলেছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো সেটি নিয়েও ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাকিস্তান

জ্বালানিতে ভর্তুকি শেষ করার পর মে মাসের শেষ থেকে পাকিস্তানে জ্বালানির দাম প্রায় ৯০% বেড়েছে। আইএমএফের সঙ্গে বেলআউট শুরু না হওয়া পর্যন্ত ব্যয়ের উপর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে।

দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। গত ১৩ বছরের মধ্যে জুন মাসে তাদের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১.৩% নেমে আসে।

শ্রীলঙ্কা ও লাওসের মতো পাকিস্তানও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের সংকটে ভুগছে। গত বছরের আগস্টের তুলনায় সেটি অর্ধেকে নেমে এসেছে।

আইএমএফ বলছে, সরকারি রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান কমাতে পাকিস্তান বৃহৎ শিল্পের ওপর ১০% কর আরোপ করেছে।

এসএন্ডপি গ্লোবাল রেটিং-এর বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু উড বিবিসিকে বলেছেন, পাকিস্তান এই তহবিল যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে তারা হয়তো সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আর্থিক ঋণদাতাদের ঋণ পেতে পারে।

এর আগে এই সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা হয়। যদিও এটিই একমাত্র কারণ ছিল না।

গত মাসে পাকিস্তান সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী দেশটির আমদানি বিল কমাতে নাগরিকদের চা পান করার পরিমাণ কমাতে বলেছেন।

পাকিস্তান বিশ্বের বৃহত্তম চা আমদানিকারক দেশ। এই পণ্যটি আনার জন্যে যে ৫১৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে সেখানে চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করে। সেখানেও একটি প্রভাব পড়েছে।

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঋণ সুবিধা নবায়ন করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ করেছে পাকিস্তান। চলতি বছর সেটি আরও বাড়তে পারে।

মালদ্বীপ

গত কয়েক বছর ধরে জনগণের ঋণ বেড়েছে মালদ্বীপের। বর্তমানে তাদের জিডিপি ১০০% এর ওপরে রয়েছে।

শ্রীলঙ্কার মতো এই দেশও পর্যটনের নির্ভরশীল হওয়ায় মালদ্বীপের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়েছিল।

পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর সরকারি ঋণের অনুপাত বেশি থাকে। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, এসব দেশগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মর্গান বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যে এই দেশও ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

লাওস

পূর্ব এশিয়ার ৭.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশও কয়েকমাস ধরে বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।

এক তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করা দেশটি খাদ্যের দামও বাড়িয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে তেলের দামের বৃদ্ধিতে জ্বালানি সরবরাহের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমে জ্বালানির জন্য দীর্ঘ লাইনের খবর দিয়েছে। আবার অনেকে তাদের বিল পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়েছে।

লাওসের মুদ্রা কিপ এই বছর মার্কিন ডলারের তুলনায় এক তৃতীয়াংশেরও বেশি কমেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদের হার ডলারকে শক্তিশালী করেছে। এ কারণে স্থানীয় মুদ্রাগুলো দুর্বল হয়েছে। এতে ঋণের বোঝা যেমন বেড়েছে তেমনই আমদানি ব্যয়বহুল হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটির রিজার্ভ ছিল ১.৩ বিলিয়ন। যেটি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় অর্ধেকের সমান।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও একটি রেলপথের মতো বড় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য লাওসকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দিয়েছে চীন।

লাওসের কর্মকর্তারা চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে বলছেন, বেইজিং গত বছরই ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের ৮১৩টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

২০২১ সালে লাওসের মাথাপিছু ঋণ জিডিপির ৮৮% ছিল। বিশ্বব্যাংকের মতে, সেই পরিসংখ্যানের প্রায় অর্ধেক পাওনা রয়েছে চীনের কাছে।

দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, ১৯৭৫ সাল থেকে লাওসে লাও পিপলস রেভোলিউশনারি পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও পরিস্থিতি বদল হয়নি।

অর্থনীতিবিদ হেরন লিম এক প্রতিবেদনে বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও জলবিদ্যুৎ রপ্তানিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে বিপদ এড়াতে তাদের এখন বেলআউট নিয়ে লড়াই করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //