বড় চ্যালেঞ্জের মুখে কৃষি খাত

বেড়েই চলেছে ভর্তুকির চাপ

করোনা মহামারির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সারের দাম বেড়েছে কয়েক মাস আগেই। এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বেড়েছে ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম। এই বাড়তি দামের ডলার দিয়ে বাড়তি দামের সার কিনতে হচ্ছে সরকারকে। দুটি মিলে বড় ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে সরকারকে। এ অবস্থায় সারের দাম বাড়ানো যেত; কিন্তু অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপে কৃষকদের অবস্থা ভালো নয়। এখন সারের দাম বাড়ালে তা হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

কৃষকরা শস্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় হুমকি হয়ে উঠবে। উভয় সংকটে পড়ে আপাতত সরকার কৃষক বাঁচানোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে এবার বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ছে। তবে সারের দাম বাড়ানোর বিকল্পটিও একেবারে ফেলে দিচ্ছে না সরকার। ভর্তুকির চাপ সামাল দিতে না পারলে পরিস্থিতি বুঝে বাড়ানো হতে পারে সারের দাম। 

করোনা মহামারির সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বিশ্বব্যাপী নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। করোনার ভয়াবহতার মধ্যেও সরকার তার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। তবে বর্তমান সংকট একেবারে তোপের মুখে ফেলেছে দেশের অর্থনীতিকে। সরকারের মন্ত্রীরাও এবার এটিকে ‘সংকট’ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির মানুষ। বাড়তি খরচ করে ফসল ফলিয়ে কৃষকদের দাম না পাওয়ার গল্প এদেশে অনেক পুরনো। সম্প্রতি জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় সেই গল্পটা এবার ট্র্যাজেডি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, কৃষক তার ফসল উৎপাদন থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে। পরিস্থিতি তখন কোথায় যেতে পারে? শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আমাদের ভাবতে সহযোগিতা করছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যে যে কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কীটনাশক ও সার ছাড়া অর্গানিক পন্থায় শস্য উৎপাদন। এতে একরকম ধরাশায়ী হয়ে গেছেন চাষিরা। বাংলাদেশেও সারের সংকট তৈরি হলে, কিংবা দাম বাড়ানো হলে এমন পরিস্থিতি যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

সার নিয়ে সংকট চলতি অর্থবছরেও ছিল। বছরের শুরুতে বাজেটে এই খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করার পথে বলে জানা গেছে। তবুও চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডির চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রবিশস্য ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।

নতুন অর্থবছরে এই ভর্তুকি ১৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে রাখার কথা ভাবছে সরকার। আর সেটি করতে হলে অবশ্যই সারের দাম বাড়াতে হবে। তবে আপাতত নির্বাচনের আগে এই ঝুঁকি সরকার নেবে না বলেই আরেকটি সূত্র জানিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাজেটে আপাতত ১৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির ঘোষণা আসবে। পরে পরিস্থিতি বুঝে বরাদ্দ বাড়ানো হতে পারে, আবার সারের দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও হতে পারে। মনে হচ্ছে, সরকার এখানে শর্টটার্ম পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে চাইছে। পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। এক ধরনের উভয় সংকটে পড়ে সরকার লাঠি না ভেঙে সাপ মারার পথে আগাতে চায়। 

এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে ওই দেশের সাথে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক আন্দোলন এড়ানো এবং নির্বাচনের আগে খামার খাতে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত কোনো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা যাবে না। তাই সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সুপারিশের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে এক বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে করণীয় সবকিছু করা হচ্ছে। 

তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিক্রিয়ায় আমরা সারের দাম না বাড়ানোর সুপারিশ করেছি। কারণ এখানে বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে দেশের কৃষি খাতে মোট ৩৮.৩০ শতাংশ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। যাদের জিডিপিতে অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কৃষককে সার ও বীজসহ কৃষি উপকরণে প্রণোদনা দিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত তথা বিগত ১৩ বছরে শুধু সারেই সরকার ভর্তুকি দিয়েছে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকিতে ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল।

গত অর্থবছরে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের আমদানি ব্যয় ছিল ৩২ টাকা, টিএসপি ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা, ডিএপি ৩৭ টাকা, যা চলতি অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রম ৯৬ টাকা, ৭০ টাকা, ৫৪ টাকা ও ৯৩ টাকায়। তবে কৃষকদের মধ্যে প্রতি কেজি ইউরিয়া যথাক্রমে ১৬ টাকা, টিএসপি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা এবং ডিএপি ১৬ টাকায় বিতরণ করা হচ্ছে।

সার্বিক খরচের বিচারে বর্তমানে প্রতি কেজি সারের বিপরীতে ইউরিয়ায় ৮২ টাকা, টিএসপিতে ৫০ টাকা, এমওপিতে ৪১ টাকা এবং ডিএপিতে ৭৯ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রাসায়নিক সারের চাহিদা ৫৭.৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, ৭.৫ লাখ টন টিএসপি, ৭.৫ লাখ এমওপি এবং ১৬.৫ লাখ ডিএপি।

বিশ্বব্যাপী ডলার, জ্বালানিসহ খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। এক বছরে সয়াবিনের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এ অবস্থায় আলোচনা উঠে এসেছে দেশেই সরিষা চাষের মাধ্য সে ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণের।

শুধু সরিষা নয়, বিশ্বে ধেয়ে আসা মন্দা মোকাবেলার একমাত্র পথ হলো দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হলে যে কোনো সংকট মোকাবেলা করা সরকারের জন্য সহজ হয়ে যাবে। এখানেই মূলত শ্রীলঙ্কা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সারের দাম বাড়ানো কিংবা অন্য কোনো কারণে কৃষক যাতে শস্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে। সারের দাম না বাড়িয়ে বরং শস্যের সঠিক মূল্য যাতে তারা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিমুখী করতে হবে। এ জন্য আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্কমুক্ত রাখতে হবে। সরবরাহ করতে হবে উন্নতমানের বীজ। তাহলেই কেবল অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //