জনগণের চাওয়া জীবন-জীবিকা রক্ষার বাজেট

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যতিক্রমী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। মানুষের আয়ের চাকা স্থির থাকলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আসছে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন বাজেট। 

নতুন বাজেটে মানুষের চাওয়া আর্থিক স্বস্তি। মানুষের আয় বাড়াতে পারে এজন্য কর ছাড়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ, ভর্তুকি বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ থাকতে হবে। অন্যদিকে লাগাম টানতে হবে অর্থ পাচার, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, প্রকল্পের নামে অর্থ অপচয়, রাজনৈতিকে উদ্দেশ্যে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে। 

করোনার ধকলের পর পর দুই বছর মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে সারাবিশ্বের অর্থনীতি। ভাইরাস একেবারে নির্মূল না হলেও, প্রকোপ অনেকটাই কমে এসেছে। ভাইরাসের সংকট কাটিয়ে ওঠার আগে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী পণ্যের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। আর যুদ্ধের কারণে ব্যাঘাত ঘটছে সরবারহ ব্যবস্থায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের আয় বাড়েনি; কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। 

এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির হিসাব-নিকাশের জন্য নতুন বাজেট প্রণয়নের সময় এসেছে। আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে পারেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটে সামগ্রিক আকার সম্পর্কে আগাম কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।

নতুন বাজেট প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দারিদ্র্য কমিয়ে এনে উন্নয়নকে টেকসই করতে বাজেটকে জনবান্ধব করাই সরকারের মূল লক্ষ্য। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। আগামী দিনে এ অর্জন ধরে রাখতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেটা আসছে সেটির সাথে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি আইসিটি খাতে আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের তরুণরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে ঘরে বসেও আয় করছে। এ খাতটিকে আমাদের শক্তিশালী করতে হবে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আগামী অর্থবছরের জন্য বাজাটের আকার হতে পারে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এটি দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৭৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে আয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ থাকতে পারে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতির প্রাক্কলন রয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি বাড়বে ২৮ হাজার কোটি টাকা। 

আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে থেকে আয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর বহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। 

আর ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ১৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আয়-ব্যয়ের গতানুগতিক ধারাবিবরণী দিয়ে বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগ। এতে গতানুগতিক বাজেট কাঠামোতে ভাঙতে হলে সেটিও করতে হবে। 

মানুষের আয় বৃদ্ধির জন্য গ্রামাঞ্চলের সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। এজন্য শিল্পঋণের পরিবর্তে গ্রামীণ ও কৃষিঋণের দিকে জোর দিতে হবে। প্রত্যেকের পকেটে নগদ অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় অনেক বাড়াতে হবে এবং স্বচ্ছতার সাথে এটির বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন। বিদ্যমান কর ব্যবস্থায় করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে করছাড়ের ব্যবস্থা জরুরি। 

আগামী বছরের নতুন বাজেট প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে এমন সময়ে যখন নিত্যপণ্যের মূল্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, বৈদেশিক বাণিজ্য খাত প্রচণ্ড চাপে রয়েছে, বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে রাজস্ব সংগ্রহ নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে না রেখে বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।

তিনি আরো বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এমন সব উদ্যোগ দরকার, যাতে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে। কৃষি উৎপাদন খরচ কম হয়। এজন্য তিনি সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি ও শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর হওয়ার সুপারিশ করেছেন। বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। সরকারকে কঠোর হাতে এসব বন্ধ করতে হবে। 

বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের কর্মজীবীরা। এমনকি মধ্যবিত্তরাও ব্যাপক চাপে পড়েছেন। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়ানো ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবীমা চালু করা প্রয়োজন। 

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যতিক্রম সময়ে বাজেট আসছে। এ রকম ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে নিম্নআয়ের ও দরিদ্র মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যায়। সেজন্য বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে। আমদানি পর্যায়ে কর ছাড় দিতে হবে। বাজেট ঘাটতি বাগে আনতে সেটা মেনে নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দুর্নীতির কারণে বড় বড় প্রকল্পে অর্থের অপচয় ও দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি। রাজনৈতিক বাহবা নিতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যেটি অর্থনৈতিক বিবেচনায় সঠিক নয়। জনসম্পৃক্ততা ও জনকল্যাণের বিষয়টি প্রকল্প গ্রহণের সময় এড়িয়ে চলা হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ শ্রীলঙ্কার। আধুনিক সময়ের একটি রাষ্ট্র দুর্নীতি ও অর্থ অপচয়ের কারণে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে সতর্ক হতে হবে। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় সংকট অর্থ পাচার । প্রতি বছর গড়ে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে। কিছু কিছু সুস্পষ্ট প্রমাণও পাওয়া গেছে। একটি ব্যাংকের এমডি পাচার করেছেন পাঁচ হাজার কোটি টাকা। পিকে হালদার নামে ওই অর্থ পাচারকারী সম্প্রতি ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থ পাচারের বড় মাধ্যমে আমদানিতে পণ্যমূল্য বেশি দেখানো ও রপ্তানিতে কম দেখানো। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য যাচাই-বাছাই করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল রয়েছে। এটি কার্যকর করতে হবে। এছাড়া হুন্ডি বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএফআইইউ ও দুদককে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। 

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ অনেক স্থিতিশীল দেশ, আবার অনেক দেশ স্টেবল না থাকলে তিন মাসের মধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কা এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। টাকার সাথে যদি ৭ থেকে ৯ ও ১০ পার্থক্য হয়ে যায় এবং বাঁধ ভেঙে যদি ১৩০ চলে যায়, তখন অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। আমরা অক্টোবর থেকে বলেছি দেশে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। তখন কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। এছাড়া শিক্ষিত বেকার এখনো বড় সংকট। কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। বাজেট প্রণয়নে এসব বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। 

বাজেটের মাধ্যমে যেহেতু আগামী এক বছরের নীতি ও বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হয় তাই নতুন বাজেট যথেষ্ট গুরুত্ব সহকার প্রণয়ন করা জরুরি। আর্থ-সামাজিক কাঠামোর একটি উন্নয়নমুখী নীতির প্রতিফলন প্রয়োজন নতুন বাজেটে। এছাড়া বাংলাদেশের যে অগ্রগতি সেটির সাথে সামঞ্জস্যতা থাকতে হবে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এটির প্রস্তুতি থাকতে হবে বাজেটে। সরকারের আয়-ব্যয়, ঋণ ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন। এ জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ বাজেটে থাকা জরুরি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //