পাটশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে যা প্রয়োজন

গৌরবময় সোনালি আঁশ বিবর্ণ হয়েছে নানা কারণে। গত ১০ বছরে সরকারের মালিকানাধীন ২৫টি জুট মিল ৪ হাজার ১৭২ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এ সময়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকিও দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা পাট খাতের দুরবস্থার পেছনে নানা কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সীমাহীন দুর্নীতি, অদক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, শ্রমিক ইউনিয়নের স্বেচ্ছাচারিতা, সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাব এবং সরকারের অবহেলা। 

বিশেষভাবে বললে পাটকে কেন্দ্র করে সরকারি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গত ৫০ বছরে নীতিগত যে দোদুল্যমানতা ছিল, তাকেও বড় করে দায়ী করা যায়। স্বাধীনতার পর শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল। সে সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া হয়েছিল সব পাটকলকে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলো শুধু লোকসানই দিয়ে আসছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুসারে, পাট খাতের ওপর ভর করে দেশের সুদিন ফেরানো যায়নি। পরে ধাপে ধাপে রুগ্ণ পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে এ খাত নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। গত ১০ বছরেও পাট মন্ত্রণালয় আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পাটকল বন্ধ করা আর চালু রাখা নিয়ে বিরোধের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি মালিকানাধীন পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। শ্রমিক ও কর্মচারীদের অবসর বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে পাওয়া পরিশোধ করা হয়েছে। নগদ অর্থ ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে এসব অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। তবে এখনো খুলনার বেশ কিছু মিলের শ্রমিক পাওনা পাননি বলে প্রায়ই আন্দোলন করছেন।

এ দিকে বন্ধ থাকা এসব জুটমিলের বিপুল সম্পত্তি নিয়ে এরই মধ্যে নানা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছু পাটকলের জমি নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে। অনেক জমি নানাভাবে বেদখল হয়েছে। এসব উদ্ধারের প্রক্রিয়া সরকারকে নতুন জটিলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ১৭টি পাটকল ইজারা দিচ্ছে সরকার। কিছু কিছু পাটকলের ইজারার জন্য এরই মধ্যে দরপত্রের মাধ্যমে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পাট খাতের উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন যে, পাট খাতের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব প্রতিষ্ঠান নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বরং অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। ফলে এসব পাটকলের সম্পদ ও অবকাঠামো ভবিষ্যতে পাট খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যবহৃত হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। 

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ১৯৯০ দশক থেকেই আলোচনায় ছিল যে, বৈশ্বিকভাবে প্লাস্টিক ও সিনথেটিকের ব্যাপক প্রসারের ফলে পাটপণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া পুরনো প্রযুক্তির চট ও বস্তা দিয়ে এ খাতের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশের পাটকলগুলোর সংখ্যা কমিয়ে, উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর এবং প্রতিযোগিতাসক্ষম পাট খাত গড়ে তোলা দরকার। সে আলোকে ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার আদমজি জুট মিলস বন্ধ করে দিয়েছিল; কিন্তু সে সময় এর ব্যাপক বিরোধিতা করা হয়েছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও তার বিরোধিতা করেছিল; কিন্তু ঠিকই দুই দশক পরে এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সরকারি মালিকানাধীন সব পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আদমজি পাটকল বন্ধ করার ফলে কয়েক হাজার পাট শ্রমিকের কর্মসংস্থান কমেছিল; কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে ওই জায়গায় আদমজি ইপিজেড স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক আধুনিক পোশাক ও অন্যান্য খাতের কারখানা স্থাপিত হয়েছে, যা প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান করেছে। 

এত কিছুর পরেও পাট খাতকে ঘিরে সম্ভাবনা একেবারেই শেষ হয়নি। পাটশিল্পের বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং অভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় নীতিগত সহযোগিতা পেলে নতুনভাবে বিশ্বের বাজারে পাটের বড় সম্ভাবনা জাগানো সম্ভব। ধারণা করা হয়, বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের ৫ হাজার কোটি (৫০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। কেননা ২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে সিনথেটিক পণ্য নিষিদ্ধ হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বাস্তবতায় সরকারও ‘উন্নত জাতের বীজ, আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, দক্ষ শ্রমিক, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও বিপণন কৌশলের উন্নয়ন ও গবেষণার কথা ভাবছে’- যা পাট খাতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখনো বিশ্ববাজারে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের পাটপণ্য রফতানি হয়, যার বড় অংশ বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকলগুলো করে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে পাটের সুতা তুরস্ক, ইরান, মিসরসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় এবং ওইসব দেশে এসব সুতা দিয়ে মূল্যবান কার্পেটসহ নানা মূল্যবান পণ্য উৎপাদিত হয়। 

বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বলছেন,  আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করে এখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য তৈরি এবং তা রফতানির দিকে মনযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া পাটের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে, বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করাও জরুরি। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনো দেশে স্থানীয়ভাবে সাড়ে ১২শ’ টন পাটবীজ উৎপাদন হলেও, পাট বীজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় পাঁচ হাজার টন। ফলে বাড়তি চাহিদা মেটাতে ভারত বা চীন থেকে প্রতি বছর বীজ আমদানি করতে হয়। 

অলাভজনকভাবে সরকারি মালিকানাধীন পাটকলগুলোকে শুধু কর্মসংস্থানের নাম করে চালু রাখা কিছুতেই অর্থনীতির দৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত কৌশল হতে পারে না। বরং এই সিদ্ধান্ত নিতে ও বাস্তবায়নে যে তিন দশক বিলম্ব হয়েছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পথ খোঁজা জরুরি। শুধু শ্রমিকের মজুরি ও সুযোগ সুবিধার বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা ও সরকারি নজরদারি বাড়ালেই বেসরকারি খাত নিরাপদ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিযোগিতাক্ষম করতে নীতি সহায়তাও দিতে হবে। পোশাক খাতের সাফল্য থেকে শিক্ষা নেওয়ারও প্রয়োজন আছে। নীতিগত সহায়তা দেওয়া হয়েছিল বলেই পোশাক খাতে শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষে। 

দ্বিতীয়ত, নিরাপদ ও সুস্থ কর্মপরিবেশ এক বড় প্রশ্ন। পাট খাতের শ্রমিকরা কিছুতেই সেই প্রত্যাশিত কর্মপরিবেশ পাচ্ছে না। বেসরকারি মালিকানাধীন পাটকলে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এখনো পোশাক খাতের চেয়ে কম। এ ছাড়া ধুলাবালি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় পাটকলে। এ কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন পাটকলে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) পাটপণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এরা শ্রমিকদের মজুরি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করে না। পাট খাতকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে হলে শ্রমিক স্বার্থের প্রশ্নটি সমাধান করেই এগোতে হবে। 

তৃতীয়ত, সময়ের পরিবর্তনে সর্বাধিক আলোচিত প্রশ্ন হচ্ছে বৈচিত্রীকৃত পাটপণ্য। রফতানির বৃহৎ শেয়ার এখনো পুরনো ধাঁচের সুতা আর বস্তা। নতুন নতুন বৈচিত্রীকৃত পাটপণ্যের রফতানি বাড়াতে হলে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের বিকল্প নেই। এদিকে অল্প কিছু বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। সুষম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

চতুর্থত, পাট খাতের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থা ও ব্যক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। দেশভিত্তিক রফতানির অবস্থা যাচাইয়ের পাশাপাশি কোন দেশে পণ্য রফতানিতে কী ধরনের সমস্যা বিরাজ করছে, তা ওয়াকিবহাল থাকা এবং সেগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পাট অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ ব্যাংক, কাস্টমস ও রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে তথ্য আহরণ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে সনম্বয় সাধন করতে হবে। মানসম্মত তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পক্ষগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে হবে। তাহলে টেকসই উন্নয়নের যে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে তার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবারও পাটপণ্য বিশ্ববাজারে নতুনভাবে বাজার বিকাশ করতে সক্ষম হবে। 

পঞ্চমত, যে বৈশ্বিক সম্ভাবনার কথা আলোচনা করা হচ্ছে সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। সেইসঙ্গে টেকসই উন্নয়নের ভ্যানগার্ড হিসেবে ‘পাটকে’ ব্র্যান্ডিং করতে হবে। এ জন্য উন্নত বিশ্বে নিযুক্ত বাংলাদেশী হাই-কমিশনগুলোতে আলাদাভাবে ‘জুট অ্যাম্বাসেডর’ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। গ্রেটা থুনবার্গের (Greta Thunberg) মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুপরিচিত ও গ্রহণযোগ্য পরিবেশবাদীর প্রচারণার মধ্যে পাটকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বহুমাত্রিক (Multi Track) কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও পাটের ব্র্যান্ডিংয়ে যুক্ত করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //